মাহি হাসান,দ্য রিপোর্ট: আবুল খায়ের হিরু, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে আলোচিত নাম।  কথিত রয়েছে হিরু যে শেয়ারে হাত দেন তার মূল্য সর্বোচ্চ সীমায় উঠে। আবার যখন শেয়ার ছেড়ে দেন তখন সর্বনিম্নে নেমে যায়। মুলত শেয়ারবাজারে কারসাজির একজন নিয়ন্ত্রক তিনি। হিরু যে শেয়ার কেনেন তার খবর দ্রুতই বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। হুমড়ি খেয়ে পড়েন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।যখন শেয়ার বিক্রি করেন তখন বিনিয়োগকারীরাও বিক্রি করে দেন। কিন্তু ততক্ষণ দেরি হয়ে যায়।শেয়ারদর তলনীতে পড়লে তখন ক্ষতিগ্রস্ত হন বিনিয়োগকারী। মূলত কোনো কারণ ছাড়াই এসব শেয়ারের দর বৃদ্ধি ঘটে। কোম্পানির পক্ষ থেকে ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা বা শেয়ার প্রতি আয় বৃদ্ধি সংক্রান্ত কোনো কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য থাকে না। মুলত সিন্ডিকেট করে দর বাড়ানো হয়।

এই হিরুকে কারসাজির দায়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন( বিএসইসি) সম্প্রতি ২ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বিয়য়টি দ্য রিপোর্টকে নিশ্চিত করেছে। তবে বিষয়টি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রকাশ করতে নারাজ কমিশন। কেননা তাতে বাজারে প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন কেউ কেউ।

বাজারে আলোচনা রয়েছে আবুল খায়ের হিরুর হাত ধরেই ডেল্টা লাইফ, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স, এনআরবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ফিড, মালেক স্পিনিং, হামিদ ফেব্রিক্স, ফরচুন শুজ, জেনেক্স ইনফোসিস ইত্যাদি কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছিলো অস্বাভাবিক হারে। যখনই তিনি শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন তখনই বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দরই কমেছে।

ডিএসইর ওয়েবসাইট সুত্রে পাওয়া খবরে জানা যায় প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর তার হাত ধরেই! গত এক বছরে ৪৩ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০২ টাকায় উঠেছে।২ বছরের হিসাবে ১৬০ টাকায় উঠেছিলো শেয়ারটির দর। বর্তমানে এটি লেনদেন হচ্ছে ৫২ টাকায়।

ডেল্টা লাইফের শেয়ারদর গত দুই বছরে ৫৮ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৩২ টাকায় উঠেছে তার হাতের যাদুতে। বর্তমানে এটি ১২৪ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।

বিমা খাতের পাইওনিয়ার ইন্সুইরেন্স কোম্পানির শেয়ারদর গত দুইবছরে মাত্র ২৯ টাকা থেকে গিয়ে ঠেকেছিল ২০৪ টাকায়। বর্তমানে এটি লেনদেন হচ্ছে ৮১ টাকায়। ফরচুন শুজের শেয়ারদর মাত্র ১৫ টাকা থেকে শুরু হয়ে তার নেতৃত্বেই ১৪৫ টাকায় ওঠে আসে গর দুই বছরে তার হাতের জাদুতে।বর্তমানে এটি লেনদেন হচ্ছে ৯৩ টাকায়। এভাবেই সাধারণ বিনিয়োগকে তিনি জুয়ার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানাগেছে এসব শেয়ারের উচ্চমূল্যের সময়ে হিরুর বিনিয়োগ ছিলো এসব কোম্পানিতে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হিরুর সঙ্গে সঙ্গে যারা শেয়ার কেনা শুরু করেছেন এবং বিক্রির সময়ে বিক্রি করেছেন তারাই বড় অঙ্কের অর্থ বানিয়েছে। তারা্ এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে শেয়ার লেনদেনকারী কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক জড়িত। কিন্তু যারা দেরিতে শেয়ার কিনেছেন তারা পথে বসেছেন, হাজারো বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়েছেন।

তবে মন্দা শেয়ারবাজারে এখন আর হিরুর খবর বিদ্যুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে না। হিরুর পক্ষ থেকে যে প্রচার বলয় তৈরি হয়েছে তারাও বেশ সতর্ক। গত ২০ ফ্রেব্রুয়ারি দ্য রিপোর্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আইটি খাতের কোম্পানি ই-জেনারেশন শেয়ার নিয়ে হিরুর করা কারসাজির বিবরণ রয়েছে।প্রতিবেদনটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে করা এক তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করা হয়েছিল। কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন নিয়ে হিরুর কারসাজির প্রমাণ পায় ঢাকা স্টক্ এক্সচেঞ্জ( ডিএসই) এর ইনভেস্ট এন্ড এনফোর্সমেন্ট বিভাগ। কারসাজির কারণে কোম্পানির শেয়ারের দর মাত্র ২৯ সেকেন্ডে ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

এদিকে বিএসইসির করা ২ কোটি টাকা জরিমানা নিয়ে বিনিয়োগাকারিদের মাঝে চলছে হাস্যরস ।কারণ পুঁজিবাজারে এখন আবুল খায়ের হিরুর ভূমিকাকে তুলনা করা হচ্ছে আরব্য রজনীর আলাদিনের সঙ্গে। তার হাতে রয়েছে চেরাগ। তাই কারসাজির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকার তুলনায় এই জরিমানা সামান্যই। বরং তাকে এভাবে রক্ষা করা হয়েছে বলে মনে করেন একজন বিনিয়োগকারী। তবে জরিমানার পর হিরু কি করেন তা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কমতি নেই । তিনি কি বিনিয়োগ গুটিয়ে নেবেন, নাকি আরো সক্রিয় হয়ে উঠবেন, সেটা দেখতে অপেক্ষায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

আবুল খায়ের হিরুই একমাত্র আমলা ! তিনি শেয়ারবাজারে এক রহস্যজনক চরিত্র হয়ে উঠেছেন। বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ থাকলেও হিরু কোনো বাধার সম্মুখীন হননি। শর্ত ভেঙে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের নামে শেয়ার নিয়ে খেলছেন , এমনটাই বলেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, সিরিয়াল ট্রেডিং বা দর নিয়ন্ত্রণের জন্য শেয়ারের লেনদেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মকর্তাই শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য জড়িত হতে পারবেন না। অন্যদিকে তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান মোনার্ক হোল্ডিংস নামের একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছেন। মোনার্ক হোল্ডিংস চেয়ারম্যান হলেন তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। এছাড়া গেলো বিপিএল এ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ক্রিকেট দল ফরচুন বরিশালের সঙ্গে জড়িত হিরু। ফরচুন বরিশালের ক্যাপ্টেন ছিলো সাকিব আল হাসান । বিদেশে বিএসইসি আয়োজিত বিভিন্ন রোড শোতেও অংশ নিয়েছেন তিনি।

বাজার পরিস্থিতি: আজ মঙ্গলবার ডিএসইতে আগের দিনের থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। ডিএসই সাধারণ সূচক ২২ পয়েন্ট বেড়ে ৬৩৪২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। গত ১০ কার্য দিবসে ১ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে মাত্র একদিন। জুন মাসের ১৬ তারিখ সর্বশেষ হাজার কোটি টাকা দেখে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক একচেঞ্জ। অনেক বিনিয়োগকারী মনে করেন হিরু মার্কেটে লেনদেন কমিয়েছে কিংবা নতুন করে কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগে গেছেন।

এ ব্যাপারে একাধিকবার যোগাযোগের চেস্টা করা হয় হিরুর সাথে। ফোনকল রিসিভ করে তিনি পরিচয় গোপণ করেন। এমনকি পুঁজিবাজারে তার কোন বিনিয়োগ নেই বলে প্রতিবেদককে জানান।

(দ্য রিপোর্ট/ মা হা/ টিআইএম/২৮ জুন,২০২২)