লোহাগড়ার সন্দেশ, পদ্মা ব্রীজ ও কমরেড সুশান্ত
তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু: কয়েকদিন আগে সুশান্ত ফোন দিয়েছিলো। আজ সকালে আবার দিলো। লোহাগড়া থেকে সন্দেশ কিনে এনেছে। ঢাকায় বিক্রি শুরু করেছে।আজ সকালের দিকে যখন সে ফোন দিলো আমি তখন মহাখালী। বললাম দুপুরে মতিঝিল আসছি দেখা হবে।
দুপুরে মতিঝিল পৌঁছে ব্যাংকের কাজ সেরে সুশান্তকে ফোন দিলাম। লোকেশন বললাম- জীবন বীমা টাওয়ারের নিচে মনু মামার চায়ের দোকানে আছি। সুশান্ত বললো ‘ আমি রাজউকে, আসছি দাদা, দুই মিনিট।’ সত্যি দুই মিনিটের মধ্যে সুশান্ত হাজির। সঙ্গে কালো ব্যাগ আর দুটি মিষ্টির প্যাকেট। প্যাকেট দুটি বেঞ্চের ওপর নামিয়ে রাখলো। আমি আরও একটি চায়ের অর্ডার দিলাম। সুশান্ত জানালো ১০ প্যাকেট মিষ্টি সে রাজউকে বিভিন্ন পরিচিতজনের কাছে বিক্রি করেছে। আর এই দুই প্যাকেট রয়েছে , এক প্যাকেটে এক কেজি সন্দেশ। বললাম- আমাকে এক কেজি দ্যাও। বললো ‘ দুই প্যাকেটই নিয়ে যান দাদা। দাম নয়শ’ টাকা। আমি বললাম - আমার কাছে টাকা আছে , কিন্তু বাজেট নেই। তাই এক প্যাকেটই দ্যাও। কালো ব্যাগ থেকে আরেকটা পলিথিনের প্যাকেট বের করে মিষ্টির চারকোণা কাগজের ঠোঙাটা পুরে দিলো।
জিজ্ঞাস করলাম এতো কম দামে তোমার পোষাবে কি করে? আপনার কাছে সাড়ে চারশ' টাকা। এটাই আমার খরচ। পাচশ' টাকা করে ঢাকায় বিক্রি করি। সবাই আমার পরিচিত। আপনার অনলাইনে একটু লিখে দেন। একটু ফিচারাইজ করে।
জিজ্ঞাস করলাম প্রতিদিন আনো এই মিষ্টি ? বললো ‘ হ্যা, প্রতিদিন আনি প্রতিদিনই বিক্রি করি। বিক্রি হয়ে যায়। ফ্রিজে রাখি না, টাটকা। রাত ৯ টায় লক্ষ্মীপাশা বাসস্টান্ড থেকে ঈগল পরিবহনের বাসে মিষ্টি উঠায়ে দ্যায় ছোট ভাডি হারান। রাত বারোটার দিকে মতিঝিলের মানিকনগরে আমার বাসার কাছ থেকে তা নামায়ে নি। বিশ-তিরিশ প্যাকেট, যা পাঠায় তাই পরের দিন বিক্রি হয়ে যায়।’
নড়াইল-লোহাগড়ার যারা ঢাকায় রয়েছেন তাদের কাছে সঞ্জয়ের মিষ্টি খুব পরিচিত ও এর সুমিষ্ট স্বাদ কম বেশী সবারই জানা। ঢাকার কোনো মিষ্টির দোকানে এতো সুস্বাদু সন্দেশ নেই এটা আামি হলফ করেই বলতে পারি। এর একটা কারণ হলো লোহাগড়ার গরু যে দুর্বা ঘাস খায় তার বিশেষ গুণ রয়েছে। মধুমতি নবগঙ্গা ও চিত্রা নদী বিধৌত এই অঞ্চলের ফসলের রয়েছে বিশেষ স্বাদ। এটা আমার পৈত্রিকভূমি বলে বলছি না, যে কেউ পরখ করে দেখতে পারেন। এখানকার ময়রারা দুধ থেকে ক্রীম বের করে নেন না। এই অঞ্চলের মানুষের কাছে কয়েকটি মিষ্টির দোকানী বা ময়রা যুগ যুগ ধরে সততার সঙ্গে ব্যবসা করে আসছেন। তারা না পারলে মিষ্টি বেঁচবে না,কিন্তু ভেজাল দেবে না। সঞ্জয় তেমনি একজন ময়রা।
১৯৯০ থেকে ৯২ সাল পর্যন্ত লক্ষ্মীপাশায় বসবাস করেছি। আব্বার চাকরীর সুবাদে এ দুই বছর যশোরে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পৈত্রিক ভিটার কাছাকাছি নড়াইল জেলার এই এলাকায় বসবাস করেছিলাম। লক্ষ্মীপাশা লোহাগড়ার প্রশাসনিক ইউনিট। নবগঙ্গা নদীর উত্তর পাশে লোহাগড়া বাজার আর দক্ষিণে লক্ষ্মীপাশা। সঞ্জয়ের দোকানের মিষ্টি খেতাম না এমন দিন কম ছিলো তখন।
লক্ষ্মীপাশা বসবাসকালীন সুশান্তের সঙ্গে পরিচয়। শুধু সুশান্ত নয়,রুপক মুখার্জী, বিপুল কুমার পাল , জহির ঠাকুর , শামীম, বাবলু, লাবলু ,মুকুল-১, মুকুল-২,এলাহী, জুয়েল ,আশরাফুল, জিল্লুর , লিটু, খায়রুল, ভটু, শিবু,কৃষ্ণ,সিন্টু বিশ্ব,মিন্টু,মুরাদ,লিখন, চেঙ্গিসসহ অনেকের সঙ্গে আড্ডা দিতাম ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর রাত, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস।
নবগঙ্গা নদীর পাড়ে মকবুলের চায়ের দোকানে দিন রাত আড্ডা। মকবুলের চায়ের দোকানের নাম দিয়েছিলাম পাংকু ক্যান্টিন। মাঝে মাঝে এই আড্ডায় আসতেন দাদাভাই, কমরেড জিকু ভাই, বদরুল ভাই , লিটন(জীবন)। কবিতা,গান , রাজনীতি, নাটক , চলচ্চিত্র, শিল্পকলা . এস এম সুলতান, বিজয় সরকার বা রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদারের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনায় দিন রাত হয়ে যেত, রাত দিন হয়ে যেতো। চা,সিগারেট আর সিঙ্গাড়া। অন্যকোনো নেশার চিহ্ন ছিলো না। প্রেম বিরহের গল্প ছিলো খুব গোপন বিষয়। এই দিনগুলো ছিলো আমার জীবনের এক স্বর্ণালী সময়।
যাহোক সুশান্তের প্রসঙ্গে আসি। সুশান্ত একজন সাংবাদিক, একজন কমরেড, একজন পূঁজারী। একজন যোদ্ধা, জীবন যোদ্ধা, ছোট কাল থেকেই সাংবাদিকতার নেশা। বাবার পেশা মাছ ধরায় মনোযোগ না দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই নিজের পড়ালেখার খরচ নিজেই জোগাড় করেছে। বাড়ির বড় ছেলে সুশান্ত লেখাপড়ার খরচ মেটাতে একসময় পেপার বিক্রি করেছে। পরবর্তীতে লোহাগড়া থেকে যশোরের বিভিন্ন কাগজে সাংবাদিকতা করেছে। এক সময় যশোর যেয়ে লোকসমাজের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছে। সেখানে টিকতে না পেরে আবার ফিরেছে লোহাগড়ায়। কোনো সময় সিমেন্টের ব্যবসা করেছে তো কখনো বাসের কাউন্টারম্যানের কাজ করেছে। টিকে থাকার লড়াইয়ে অসংখ্য পেশা বদল করেছে।
তবে বড় যে কাজটি সে করেছে তা হলো ”শতাব্দীর আলো” নামের একটি পাক্ষিক পত্রিকার ডিক্লিয়ারেশন নিয়েছে। পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হয়েছে। সেটা নিরানব্বই সালের কথা। প্রথম সংখ্যার প্রকাশটা আমার হাত দিয়েই হয়েছিলো। আমি তখন লোকসমাজে সাংবাদিকতা করি। সারারাত জেগে সুশান্তের শতাব্দীর আলো যশোরের লোকসমাজের প্রেস থেকে বের করে দিয়েছি। যশোর থেকে তিরিশ মাইল দূরে লোহাগড়ায় নিয়ে সুশান্ত সে পত্রিকার প্রকাশনা উৎসব করেছে। আমি তার এই অর্জনকে সাধুবাদ জানাই।
কি অসীম সাহস আর ধৈর্য্য সুশান্তের তা ওকে কাছ থেকে না জানলে বিশ্বাস করা যাবে না। নড়াইলের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা ওর সহজাত। সৎ ও সোজা পথের মানুষ। কখনো মিথ্যা বলে না, বলানো যাবে না। ওর রাজনৈতিক আদর্শের নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির হাফিজ সাহেব যখন নড়াইলের এমপি তখন কী এক অভিমানে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছে। কোনো সুবিধা নিতে যায় নি। অথচ হাফিজ সাহেবের পক্ষে ভোটের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলো। ওর ব্রেইন চাইল্ড ‘‘শতাব্দীর আলো’’র জন্য কোনো ধরণের বিজ্ঞাপন বা আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করতে যায়নি।
ঢাকায় আসার পর অনেক রাত শাহবাগে আড্ডায় মেতেছি আমরা। রমনা কালীমন্দির থেকে পূঁজা সেরে এসে কার্লমার্কসের আদর্শের পক্ষে জোরালো যুক্তি দেখিয়েছে। ধর্মের সঙ্গে মার্কসবাসের কোনো বিরোধ নেই সে কথা সে জোরেশোরেই উপস্থাপন করেছে। তার এই যুক্তি নিয়ে বহুবার নাড়াচাড়া করেছি। ওকে টলাতে পারিনি। ও ওর অবস্থানে অনড়। যা বোঝে হাজার চেষ্টা করেও সেখান থেকে সরানো যাবে না। রাজনীতি , ধর্ম বিশ্বাস, দেশপ্রেম কোনো অবস্থান থেকে ওর চ্যুতি নেই। ও সাহসী ও ঋজু । আমি ওর এই সাহস ও সততাকে শ্রদ্ধা করি।
শাহবাগের আড্ডায় ওকে কেউ চা খাওয়াতে পেরেছে বলে মনে পড়ে না। সবার আগে সুশান্তই বিল দিয়ে দিয়েছে। কখনো সামনে কখনো গোপনে। ঢাকায় বসবাসকারী নড়াইলের মানুষের খুব প্রিয় মানুষ সুশান্ত বিশ্বাস। তাই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন সহায়তা পেতে খুব বেশী কষ্ট হয়নি। তবে তা দিয়ে পত্রিকার খরচ মিটেছে, কিন্তু জীবন চলেনি , জীবন চলে না।
সুশান্ত স্বপ্ন দেখে ওর কাগজটি একদিন দৈনিক হবে। একদিন একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হবে। আমি এ নিয়ে অনেক বার বলেছি বিক্রি করে দ্যাও। তাহলেই হয়তো দৈনিক হবে তোমার কাগজ। এখন যে পুঁজি লাগে তা তোমার নেই, তুমি পারবাও না। ও চুপ করে থাকে , চোখ ছল ছল করে ওঠে। আমি আর খোঁচায় না। অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই।
আমার সঙ্গে বা আমার পরিবারের সঙ্গে সুশান্তের যোগাযোগটা কখনো কেটে যায় নি । দাদাভাই , লিটন বা আমি আমাদের এই তিন ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে বিনাসুতোর মালার মতো, আমাদের পাঁচ ভাইয়ের মতোই যেন ও আমাদের আরেক ভাই। বিপদ আপদের কোনো খবর শুনলে সুশান্ত লোহাগড়া থেকে যশোর চলে গেছে। লোহাগড়া , যশোর বা ঢাকা এই তিন জায়গায় সুশান্তের সমান বিচরণ।
নিজের লড়াইটা নিজেই করতে হয়েছে ওকে। করতে হচ্ছে। এখন স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে চার জনের সংসার। বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাতে ঢাকায় বসবাস করছে। ঢাকার দিন যাপন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। তাইতো নতুন এক ব্যবসার সন্ধানে নেমেছে। সুশান্ত এখন আবার মিষ্টির ব্যবসায়ী হতে চলেছে। আমি বললাম একবছরের মধ্যেই তুমি দাড়িয়ে যাবে আশা করা যায়। দিনে ২০ হাজার টাকা লেনদেন করতে পারবা। বললো ‘ দাদা এক বছর লাগবে না। ছয় মাস যাতি দেন। তারপর কবেনেন, একবার যে খাচ্ছে সে আবার অর্ডার দেচ্ছে। আপনি বোঝেন না,এই মিষ্টি কী ঢাকায় কেউ দ্যাখছে না খাইছে। আমি বললাম- ঠিক একশ ‘ভাগ ঠিক।
পদ্মাব্রীজ দক্ষিণবঙ্গের ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্যের দরজা খুলে দিয়েছে। ৯ ঘন্টার পথ তিন ঘন্টায় নেমেছে। কাঁচামাল, মাছ তরকারি এই অঞ্চলের মানুষ নিয়ে তিন ঘন্টায় মতিঝিলের বাজার ধরতে পারছে। এটা ৫০ বছর পরের অর্জন। আমি মনে করি আরো ৩০ বছর আগেই এই ব্রীজ হওয়া দরকার ছিলো।আমরা কোলকাতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছি সেই কবে থেকে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর দেশের রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলাম এ বছর পঁচিশে জুন। তারপরও ধন্যবাদ সরকারকে এই সাহসী ও সুদূর প্রসারী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ।
বাসায় নিয়ে যখন স্ত্রী পুত্রকে লোহাগড়ার সন্দেশ খাওয়ালাম,খেলাম, স্ত্রী বললো , সুশান্তের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত এক কেজি সন্দেশ নিয়ে এসো।
মিষ্টি খেয়ে আমি ফিরে গেলাম এক নস্টালজিক আড্ডায়,১৯৯০-৯২ সালে।
আহ্ সন্দেশ। লোহাগড়ার সন্দেশ। জয়হোক পদ্মাসেতুর, জয়হোক কমরেড সুশান্তের।
যা বলছিলাম, সুশান্ত যখন মিষ্টির প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিলো তখন "শতাব্দীর আলো"র সর্বশেষ সংখ্যাটিও সঙ্গে দিলো,ওটা যে ওর মস্তিস্কজাত সন্তান।
তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু/চব্বিশ জুলাই/ দুই হাজার বাইশ/ দ্য রিপোর্ট/