ডলার লেনদেনে অস্বাভাবিক মুনাফা , ছয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: ডলার লেনদেনে অনিয়মের মাধ্যমে অস্বাভাবিক মুনাফা করার অভিযোগে বাংলাদেশের ছয়টি ব্যাংকের 'জড়িত' কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
খবর বিবিসি বাংলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে এই ব্যাংকগুলোর নাম বলা হয়নি, তবে প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র বিবিসি বাংলাকে বলেছেন এর মধ্যে পাঁচটি দেশি ব্যাংক একটি বিদেশি ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলছেন, ''ডলার ক্রয়-বিক্রয়ে অত্যধিক লাভ করার কারণে ছয়টা ব্যাংকের, যার মধ্যে দেশি পাঁচটা আর বিদেশি একটা আছে, এই অত্যধিক লাভের সাথে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়ার জন্য বলা হয়েছে।''
সোমবার রাতে এই নির্দেশনার চিঠি পাঠানো হয়েছে ব্যাংকগুলোর কাছে।
এই নির্দেশনার পর ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই শেষে তাদের বরখাস্ত করা, ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করা বা বদলি করার মতো যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরাখবরে জানা যাচ্ছে, এই কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদের কর্মকর্তাও রয়েছেন।
এর আগে ২০০২ সালে পাঁচটি ব্যাংক থেকে ভারতীয় এক ব্যবসায়ীর জালিয়াতির মাধ্যমে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করলে ওই পাঁচ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের অপসারণ করা হয়েছিল।
যে অভিযোগে ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশে গত মে মাস থেকে ডলারের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার পর এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা ডলার লেনদেন করে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পেয়েছে বলে গণমাধ্যমগুলো খবর দিচ্ছে।
আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৯৫ পয়সায় বিক্রি হলেও খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় হার উঠেছিল ১১৪ টাকায়।
এ সময় কোন কোন ব্যাংক ক্রয়মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে লিখেছে দেশের শীর্ষ সংবাদপত্র দৈনিক প্রথম আলো।
ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে যে দামে ডলার বিনিময় করে থাকে, তাকে সংক্ষেপে আন্তঃব্যাংক লেনদেন বলা হয়।
সেই বিনিময় হারের সর্বোচ্চ ধরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সেই হারের ওপর ভিত্তি করে ডলার ক্রয়-বিক্রয় করে থাকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এই লেনদেনে সর্বোচ্চ এক থেকে দেড় টাকা মুনাফা করার কথা ব্যাংকগুলোর।
অর্থাৎ আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার ৯৫ টাকা হলে ব্যাংক রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৯৩ টাকায় ডলার কিনতে পারে, সর্বোচ্চ বিক্রি করতে পারে ৯৭ টাকা।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে স্থানীয় দৈনিকগুলো লিখছে, কোন কোন ব্যাংক যে দামে ডলার কিনেছে, তার চেয়ে পাঁচ থেকে ১০ টাকা বেশি লাভে লেনদেন করেছে।
এসব অভিযোগে সোমবার জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
যেসব ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে, তাদের শীর্ষ কোন কর্মকর্তা এই ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।
তবে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) মহাসচিব খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ''সোমবার রাতে আমরা চিঠিটা পেয়েছি। এখন আমাদের পরবর্তী যে ফোরাম বা মিটিং হবে, সেখানে এই বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো। তার আগে এ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না। ''
একসময় ব্যাংকে ডলারের বিনিময় হার বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করে দিতো। এই বছরের জুন মাস থেকে সেটা তুলে নেয়া হয়। ফলে চাহিদা ও যোগানের সাথে সাথে ব্যাংকগুলোয় আন্তঃব্যাংক লেনদেনের হার নির্ধারিত হয়।
তবে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে দরে ডলার কিনে থাকে ব্যাংকগুলো, সেটাকেই ডলারের আনুষ্ঠানিক দর হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
কিন্তু এর ফলে ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়তে থাকে। মে মাসের শুরুতে বিনিময় মূল্য ৮৫ টাকা ৪৫ পয়সা থাকলেও সোমবার খোলা বাজারে বিক্রি হয়েছে ১১৫ টাকা দরে।
আমদানি বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়েও আমদানি দায় পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়িয়েছে।
কিন্তু এসব উদ্যোগে ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়নি। এরই সুযোগে খোলা বাজারের মতো কোন কোন ব্যাংক যে দরে ডলার কিনেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি দরে ডলার বিক্রি করেছে গ্রাহকদের কাছে। একেক ব্যাংক একেক রকম রেট নিচ্ছে গ্রাহকদের কাছ থেকে।
এমনকি ক্রেডিট কার্ড লেনদেনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে রেটে ডলার কিনেছে ব্যাংক, তার চেয়ে বেশি রেটে চার্জ করা হয়েছে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেন, গত কয়েক মাস ধরে ডলার মার্কেট অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। রপ্তানি থেকে যা আসে, তার চেয়ে আমদানির এলসি বেশি রয়েছে। সেসব এলসির পেমেন্ট করার জন্য বাধ্য হয়ে বেশি দামে আমাদের ডলার কিনতে হচ্ছে, সেটা বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে।
তিনি বলেন, দুবাই বা লন্ডনের এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো একশো টাকার অনেক ওপরে ডলার কিনছে। ফলে ব্যাংকগুলোকে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় সর্বোচ্চ এক থেকে দুই টাকা লাভের কথা বলা হয়েছে।
ডলারের ক্রয় হারের চেয়ে অনেক বেশি লাভে বিক্রি করার প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ''কোন কোন ব্যাংক হয়তো বেশি মুনাফা করার একটু সুযোগ নিতে চেয়েছে। তবে বেশিরভাগ ব্যাংকই কিন্তু নিয়মের মধ্যে থেকে ডলার কেনাবেচা করছে।''
কোন কোন ব্যাংক অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে
অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক ব্যাংকার মামুন রশীদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ডলারের বিনিময় হারের বিষয়ে "সরাসরি কোন আইন না থাকলেও বাজার যখন অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর দায়িত্ব বর্তায় যেন গ্রাহক স্বার্থ বিঘ্নিত না হয় এবং সেই সময় যেন নিয়মনীতি মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ হিসাবে তাদের এটা করতে হয়। এজন্য তাদের অনেকগুলো গাইডলাইন রয়েছে।''
''বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি গাইডলাইনে বলা আছে, ব্যাংকগুলো তাদের কার্যক্রম শুরুর দিনে কতো ডলার ধরে রাখতে পারবে (নেট ওপেন পজিশন) এবং কতো কারেন্সি কতদিনের জন্য কিনে রাখতে পারবে বা বিক্রি করতে পারবে।''
নিয়ম অনুযায়ী, একটি ব্যাংক তার মোট মূলধনের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রাখতে পারে। এর বেশি থাকলে তা বাজারে বিক্রি করে দিতে হয়।
''দ্বিতীয় একটি গাইডলাইন হচ্ছে, ব্যাংক কি প্যারামিটারের মধ্যে কার্যক্রম চালাবে। বৈধ লেনদেন ছাড়া নেট ওপেন পজিশনের বাইরে কোন ডলার ধরে রাখা যাবে না। বৈধ লেনদেন বলতে বোঝানো হয় গ্রাহকদের লেনদেন,'' বলেন মামুন রশীদ।
বিশেষ করে ক্রয় ও বিক্রয়ের মধ্যে কতটুকু পার্থক্য রাখা যাবে, সেটাও বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি গাইডলাইনে বলা হয়েছে।
মামুন রশীদ বলেন, যেসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তারা ক্রয়-বিক্রয়ে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করেছে বলে দেখতে পেয়েছে পরিদর্শন দল। যেমন একটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পেয়েছে, তারা ৯৩ টাকায় ডলার কিনে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকদের কাছে ৯৯ টাকায় বিক্রি করেছে। কিন্তু এই পার্থক্য হওয়ার কথা সর্বোচ্চ দুই টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের এই অনিয়মের বিষয়ে আরও আগে কেন ব্যবস্থা নেয়নি জানতে চাইলে মুখপাত্র মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলছেন, ''মার্কেটের সব কিছুই যে আমাদের নজরে ইমিডিয়েটলি হয়, তাতো না। যখন আমরা তাদের কাছে তথ্য চাই, সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করি, ইন্সপেকশনে লোক পাঠাই, তার পরে তো বিষয়টা আমাদের নজরে আসে। কিন্তু আমাদের নজরে এলে সাথে সাথেই ব্যবস্থা নেয়া হয়, এক্ষেত্রেও যেমন নেয়া হয়েছে।''
সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলছেন, ''বাজারে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলো নর্মাল ব্যাংকিং অপারেশনে ব্যাংকগুলো যা মুনাফা করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি মুনাফা করেছে এই ফরেন এক্সচেঞ্জ লেনদেন থেকে, ভলাটাইল মার্কেটের সুযোগ নিয়ে। অনেক বিষয় সাধারণ গ্রাহকদের বিপরীতে চলে গিয়েছে।''
ফলে রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক এরকম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
রপ্তানি বা রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশে পর্যাপ্ত ডলার না আসা, হুন্ডির আধিক্য, বেশি দামে ডলার কিনতে চাওয়া, ব্যাংকের মুনাফা করার চেষ্টা- অনেকগুলো কারণে ডলারের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে বলে তিনি মনে করেন। দ্য রিপোর্ট/ টি আই এম/