এবার নির্বাচন সামনে রেখে কী কৌশল নেবে বিএনপি?
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদন: বাংলাদেশে গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগে কোন কৌশল নেবে? এই দলের ভবিষ্যৎ কী? কোন পথে এগুবে বিএনপির রাজনীতি?
বিবিসি বাংলায় এ নিয়ে কাদির কল্লোলের লেখা প্রতিবেদনটি দ্য রিপোর্টের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
তিন দফায় দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা এই দলটির অনেক নেতা-কর্মীকেই আজ ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে হয়তো এই আত্ম-জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হবে। বিএনপির নেতারা ইতোমধ্যে বলে দিয়েছেন, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে তারা আর যাবেন না। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে বিএনপি এখন আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এই আন্দোলন কি সব বিরোধী দলকে এক মঞ্চে এনে করা হবে, নাকি স্ব স্ব অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলন- এই প্রশ্নে বিএনপিতে ভিন্ন মত আছে।
দলটির মূল নেতৃত্ব এমুহূর্তে অবশ্য তাদের পুরোনো জোটকে সক্রিয় করা বা কোনো একটি একক মঞ্চ তৈরির চিন্তাও করছে না।
পনেরো বছর ধরে বিএনপি যে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে, এটি যে দলের জন্য বড় সঙ্কট, তা দলের নেতারাও স্বীকার করছেন।
বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল কয়েকটি দলের সাথে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ।
কিন্তু বিগত দু'টি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি এবার এখন পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
বিএনপি গত কিছুদিন ধরে সারাদেশে একটি সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে সমাবেশ, মিছিল বা বিক্ষোভের মত কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে।
গত সপ্তাহে অন্তত বিশটি জেলায় বিক্ষোভ করতে গিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মিদের সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে।
বিএনপি তৃণমূলে কী বার্তা দিয়েছে?
উত্তরের একটি জেলা শেরপুর থেকে বিএনপির একজন নেত্রী সানসিলা জেবরিন প্রিয়াঙ্কা বলেছেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে তাদের রাজপথে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে হবে-দলের কেন্দ্র থেকে এখন তাদের এই একটি বার্তা দেয়া হয়েছে।
"দলের এখন একটাই বার্তা, দল যে কর্মসূচি দিচ্ছে, সেগুলোতে আমাদের সংঘবদ্ধভাবে অংশ নিয়ে মাঠে অবস্থান শক্ত করা" বলেন শেরপুরের বিএনপির একজন নেত্রী।
আরও কয়েকটি জেলা রাজশাহী, বগুড়া, যশোর, সিলেট, চট্টগ্রাম এবং খুলনা থেকে বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মির সাথে কথা হয়।
তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন ক্ষমতাসীন দলের দাপট এবং মামলা বা পুলিশী হয়রানির ভয় উপেক্ষা করে এবং নানা ঝুঁকি নিয়েই মাঠে নামছেন।
তারা মনে করেন, দেশে জ্বালানি তেল এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাবে মানুষের মাঝে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এবং সরকার কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি চাইছেন।
'বিএনপি ভাঙেনি, সেটাই এখন বড় শক্তি'
আওযামী লীগের টানা শাসনামলেও বিএনপির ঐক্যবদ্ধ থাকার বিষয়কে এখন দলটির বড় শক্তি বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী।
তিনি উল্লেখ করেন, লম্বা সময়ে চরম বিপর্যস্ত বিএনপিতে যে ভাঙন হয়নি, সেকারণেই দলটির মাঠের নেতাকর্মীরা এখন মাঠে সক্রিয় হচ্ছে।
"দেশের মানুষ একটা সুষ্ঠু এবং ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য ব্যস্ত হয়ে আছে। সুতরাং বিএনপির জন্য আন্দোলন করাটা সহজ হবে" বলেন অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী।
আন্দোলনের ধরন নিয়ে তৃণমূলের ভাবনা
বিভিন্ন জেলায় বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মিদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, তাদের একটা বড় অংশ অন্য দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন নয়, তারা বিএনপির নেতৃত্বে একটা ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ বা প্লাটফর্মের মাধ্যমে কঠোর আন্দোলনের পক্ষে।
বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতাও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তারাও একই মত পোষণ করেন।
কিন্তু দলটির মূল নেতৃত্ব এই মুহূর্তে তাদের জোট কার্যকর করার পক্ষে নন। তারা সরকার বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
যুগপৎ আন্দোলনের ব্যাখ্যায় তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বিএনপির দাবির সাথে ডান বামপন্থী যে দলগুলো একমত হয়েছে, সেই দলগুলো স্ব স্ব অবস্থানে থেকে অথবা বিভিন্ন দল সমমনাদের নিয়ে জোট করেও বিএনপির সাথে একই কর্মসূচি আলাদাভাবে পালন করবে।
যেমন আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, রেজা কিবরিয়া, নুরুল হক নুর, এবং জোনায়েদ সাকি-এই নেতাদের নেতৃত্বাধীন সাতটি দল ইতিমধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ নামে একটি জোট গঠন করেছে।
এই জোট বিএনপির সাথে যুগপৎ আন্দোলন করার কথা বলেছে।
অন্যদিকে ইসলামপন্থী কিছু দল তাদের অবস্থানে থেকে বিএনপির সাথে যুগপৎ আন্দোলনে থাকবে।
এক মঞ্চে নেতৃত্ব দেয়ার মত নেতার অভাব
তবে সরকার বিরোধী সব দলকে একটি প্লাটফর্মে এনে একজন নেতার নেতৃত্বে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে তোলা, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এমন ইমেজের নেতা এমুহূর্তে বিএনপিতে নেই বলে দলটির কোন কোন নেতা মনে করেন।
বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, "বিএনপি যদি এখন থেকে এক মঞ্চে আন্দোলন শুরু করে,তাহলে নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।"
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, "খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপিতে সারাদেশে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব নেই বলে অনেকে মনে করেন।"
২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের উদাহরণ টেনে মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, "অতীতে ড: কামাল হোসেনকে নেতৃত্বে নিয়ে বিএনপি যে লক্ষ্যে এগিয়েছিল, তাতে বিএনপির ক্ষতিই হয়েছে।"
সেজন্য বিএনপি এবার আগে থেকেই সাবধান হয়েছে বলে মনে করেন মি: আহমেদ।
ফলে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনকে চিন্তাকে তিনি সঠিক বলেই মনে করেন।
বিএনপির নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেছেন, "দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মহাসচিব-তাদের জনপ্রিয়তা আছে। জনগণকে রাজপথে নামিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
"কিন্তু এখন পর্যন্ত বড় সাফল্য তাতে দেখছি না। তবে আশা করি বর্তমান সরকারের লাগাতার ব্যর্থতার কারণে এক সময় এই আন্দোলন সফল হতে পারে" বলেন মি: আহমেদ।
দুর্নীতির অভিযোগে মামলায় সাজা নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুই বছর জেল খাটার পর আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্ত রয়েছেন।
তিনি বয়স এবং অসুস্থতার কারণে রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। দলটির আরেক শীর্ষ নেতা তারেক রহমান দেশের বাইরে রয়েছেন দীর্ঘ সময় ধরে।
পুরোনো ২০ দলীয় জোটকে অকার্যকর করে রাখায় এই জোটে থাকা জামায়াতে ইসলামীসহ বিএনপি অন্য শরিকরা বিভিন্ন সময় তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
বিগত নির্বাচনের আগে ড: কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরামসহ কয়েকটি দলকে নিয়ে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের ভিন্ন আরেকটি যে জোট গঠন করেছিল, সেই নির্বাচনের পর ঐ জোটও ভেঙে গেছে।
যুগপৎ আন্দোলনের প্রস্তুতি
বিগত দু'টি নির্বাচনে বিএনপির কৌশলগত ভুল ছিল বলে দলটির নেতৃত্ব মনে করে। সেকারণে এখন তারা যুগপৎ আন্দোলনের পথে হাঁটছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ডান-বাম, সবপন্থী দলকে সরকার পতনের একদফা দাবিতে যুক্ত করতে তারা যুগপৎ আন্দোলনে যাচ্ছেন।
এর ব্যাখ্যায় মি: আলমগীর আরও বলেন, "যুগপৎ আন্দোলন দিয়ে আমরা শুরু করছি। তারপরে আন্দোলনের ধারাই বলে দেবে যে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি।
"তখন এক মঞ্চে যাবে নাকি অন্যভাবে যাবে, সেটা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাজপথেই বোঝা যাবে" বলেন বিএনপি মহাসচিব।
যুগপৎ আন্দোলনের টার্গেট নিয়ে বিএনপি একদফা বিভিন্ন দলের সাথে আলোচনা করেছে।
এখন দলগুলোর প্রতিনিধি নিয়ে সমন্বয় কমিটি করে জেলায় জেলায় নেতাদের সফর এবং সমাবেশের পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন।
কিন্তু যুগপৎ আন্দোলন কবে নাগাদ শুরু করা সম্ভব হবে-সেটা তারা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না।
এছাড়া যুগপৎ আন্দোলন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করা সম্ভব হবে কীনা-এই প্রশ্নেও বিএনপিতে তৃণমূলে সন্দেহ এখনও কাটেনি।