চারটি এলাকা রাশিয়ার অংশ ঘোষণার পর কিয়েভের উদ্দেশ্যে বার্তা
এই শত্রুতা বন্ধ করুন , এই যুদ্ধ শেষ করুন : পুতিন
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: ইউক্রেনের চার অঞ্চলকে রাশিয়ার অংশ ঘোষণার ভাষণে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির পশ্চিমা মিত্রদের কঠোর সমালোচনা করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেছেন, পশ্চিমারা ভূমি ও সম্পদের দখল নিতে পশুর মতো মানুষ শিকার করছে।
সাত মাসের যুদ্ধে ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেয় রাশিয়ার সেনাবাহিনী। ওই চার অঞ্চলে গণভোট আয়োজনের পর শুক্রবার মস্কোয় এক অনুষ্ঠানে অঞ্চলগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার অংশ ঘোষণা করেন পুতিন। অঞ্চলগুলো হলো ইউক্রেনের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া। অঞ্চলগুলোকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার বিষয়ে একটি চুক্তিতে পুতিন এবং অঞ্চলগুলোতে রাশিয়া নিয়োজিত প্রশাসকেরা সই করেন।
রাশিয়ার এমন পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইউক্রেন ও পশ্চিমা দেশগুলো। চুক্তি সইয়ের সে অনুষ্ঠানে ৩৭ মিনিটের দীর্ঘ এক ভাষণ দেন পুতিন। সেখানে তিনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, পশ্চিমা দেশগুলোর ঔপনিবেশিক নীতি, পারমাণবিক অস্ত্র ও পশ্চিমা মূল্যবোধ সম্পর্কে নিজের ভাবনা তুলে ধরেন।
চুক্তি সই অনুষ্ঠানে বরাবরের মতোই রুশ ভাষায় বক্তৃতা করেন পুতিন। তাঁর দেওয়া সেই ভাষণের অংশবিশেষ তুলে ধরেছে আল-জাজিরা।
‘আমাদের ভূমি’ রক্ষা
ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ‘আমরা সব শক্তি দিয়ে আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করব।’ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘১৯৯১ সালে তৎকালীন পার্টির অভিজাতদের প্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষের মতামত না নিয়ে বেলোভেজ চুক্তির মাধ্যমে ইউনিয়ন অব সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক (ইউএসএসআর) ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এতে মানুষ হঠাৎ মাতৃভূমি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন অনুভব করেন। এটা (সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন) আমাদের জাতিকে বিচ্ছিন্ন ও বিভাজিত করে, যা জাতীয় বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে...।’
ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ‘আমি স্বীকার করছি, তাঁরা কী করছিলেন এবং এর পরিণাম শেষ পর্যন্ত কী হবে, সে বিষয়ে তাঁরা তখন পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। কিন্তু এখন আর সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। অতীতকে ফিরিয়ে আনা যায় না এবং রাশিয়ার এখন তার দরকারও নেই। আমরা এর পেছনে ছুটছি না।’
পুতিন বলেন, ‘ভাগ্য ও ইতিহাস আমাদের যে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে গেছে, সেই যুদ্ধ আমাদের জনগণের জন্য, ঐতিহাসিক মহান রাশিয়ার জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, আমাদের সন্তান, নাতি-নাতনি ও তাদের সন্তানসন্ততিদের জন্য।’
কিয়েভের জন্য বার্তা
‘কিয়েভ কর্তৃপক্ষ ও পশ্চিমে তাদের প্রকৃত গুরু যাঁরা কলকাঠি নাড়ছেন, তাঁদের বলতে চাই, আমার এই কথাগুলো শুনে মনে রাখুন। লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ায় বসবাসরত মানুষ আমাদের (রাশিয়া) নাগরিক হচ্ছেন। চিরতরের জন্য তাঁরা তা হচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘কিয়েভ সরকারকে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, যত দ্রুত সম্ভব এই শত্রুতা বন্ধ করুন, এই যুদ্ধ শেষ করুন। ২০১৪ সালে তারা এ যুদ্ধে শুরু করেছিল। একই সঙ্গে তাদের আবারও আলোচনার টেবিলে ফেরার আহ্বান জানাচ্ছি।’
পুতিন বলেন, ‘আমরা আলোচনার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের মানুষেরা যা বেছে নিয়েছেন, তা নিয়ে আমরা কোনো আলোচনা করব না। এটা শেষ হয়ে গেছে। রাশিয়া কখনো তাঁদের ধোঁকা দেবে না।’
নর্ড স্ট্রিট গ্যাস পাইপলাইনে ছিদ্র
ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ‘অ্যাংলো-স্যাক্সনরা নিষেধাজ্ঞা দিয়েই ক্ষান্ত হয় নাই। তাই তারা নাশকতার পথ বেছে নিয়েছে। এটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন হলেও সত্য যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সংগঠিত হয়ে আন্তর্জাতিক গ্যাস সরবরাহের দুটি পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিমে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এ থেকে কারা ফায়দা পাবে, সেটা সবার কাছেই স্পষ্ট।’
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ
রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘পশ্চিমারা মধ্যযুগের মতো আবারও তাদের ঔপনিবেশিক নীতি ফিরিয়ে এনেছে। একইভাবে তারা দাস ব্যবসা, আমেরিকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর গণহত্যা, ভারত ও আফ্রিকায় লুণ্ঠন এবং চীনের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের যুদ্ধ ফিরিয়ে এনেছে।
‘তারা যা করছে সেটা হচ্ছে পুরো জাতিকে মাদকে নিমজ্জিত ও ইচ্ছাকৃতভাবে সমগ্র জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করার পথ বেছে নিয়েছে। ভূমি ও সম্পদের জন্য তারা পশুর মতো মানুষ শিকার করছে। এটা মানুষের মানবিক প্রকৃতি, সত্য, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।’
পারমাণবিক হামলার নজির
ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বে একমাত্র দেশ, যারা দুবার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। জাপানের দুই শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকি ধ্বংস করে দিয়ে তারা নজির সৃষ্টি করেছে। এমনকি আজও তারা পারতপক্ষে জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশ দখল করে রেখেছে। তারা আবার এর নাম দিয়েছে পারস্পরিক স্বার্থভিত্তিক মিত্রতার সম্পর্ক।’
পশ্চিমা ‘নৈতিকতা’
পশ্চিমাদের সমালোচনা করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এখন তারা সম্পূর্ণভাবে নৈতিক বিধিবিধান, ধর্ম ও পরিবারকে অস্বীকারের দিকে চলে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা অভিজাতদের স্বৈরশাসন সব সমাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমা দেশের নাগরিকেরাও রয়েছেন। এটা সবার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এটা মানবতাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার, ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে ছুড়ে ফেলা। প্রকৃতপক্ষে তাদের স্বাধীনতার দমন এখন একটি ধর্মের চেহারা নিয়ে, আর তা হলো সম্পূর্ণরূপে শয়তানবাদ।’
দ্য রিপোর্ট / টিআইএম/