দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: আগামী বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে আলোচনায় বসবে ঢাকায় সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল। আর এদিনই সংস্থাটির কাছে চাওয়া ঋণের শর্তগুলো চূড়ান্ত হবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, অর্থনীতিতে ভর্তুকির বোঝা কমানো, ব্যাংকিং খাতে ঋণের সুদের উপরিসীমা তুলে দেওয়া ও খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং রিজার্ভ ও খেলাপি ঋণের হিসাবায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা।

আইএমএফের এই শর্তগুলোর অধিকাংশই মেনে নিতে পারে বাংলাদেশ। আরও কয়েকটি শর্ত নিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। এই বিষয়গুলো চূড়ান্ত হবে মঙ্গলবার অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে। এই শর্তগুলো পরিপালনে রাজি হলেই বাংলাদেশকে আগামী তিন বছরে এই ঋণ পাবার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে।

সূত্র জানায়, আইএমএফের শর্তের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। গতকালও অর্থ বিভাগের দুটি উইংয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইএমএফ কর্মকর্তারা দুই দফায় বৈঠক করেছেন। এর একটি বৈঠক হয়েছে সামষ্টিক অর্থনীতি উইংয়ের প্রধান অতিরিক্ত সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান মজুমদারের সঙ্গে। অন্য বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় বাজেট-১ এর অতিরিক্ত সচিব সিরাজুন নুর চৌধুরীর সঙ্গে। বৈঠকগুলোতে আইএমএফের শর্তগুলোর বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।

তবে বৈঠকে কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে সে বিষয়ে দুই অতিরিক্ত সচিবের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। বিষয়টি অত্যন্ত ‘স্পর্শকাতর’ হিসেবে উল্লেখ করে আগামী ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আইএমএফের বেশ কয়েকটি শর্ত অর্থনীতির জন্য ভালো হলেও তা সরকারের জন্য বেশ স্পর্শকাতর। যেমন-আইএমএফ ভর্তুকি কমিয়ে আনার কথা বলেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে সরকার জ্বালানি তেলে কোনো ধরনের ভর্তুকি দিচ্ছে না। উপরন্তু সর্বোচ্চ ৫২ শতাংশ দাম বাড়ানোর কারণে এখন সরকারি জ্বালানি বিপণনকারী সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) তেল বিক্রি করে মুনাফা করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সার ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আর সামনে নির্বাচনের এই সময়ে এসব পণ্যে ভর্তুকি কমিয়ে আনা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তাই অর্থ বিভাগের পক্ষে ভর্তুকির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।

সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক সুশাসনের বিষয়টি সবাই চায় বলে আইএমএফকে বলা হয়েছে। খেলাপি ঋণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আন্তর্জাতিক মানের হিসাব পদ্ধতির বিষয়ে যে শর্ত দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষে তা মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। ঋণের সুদের সীমা একেবারে তুলে না দিয়ে তার উপরিসীমা বাড়ানোর বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়েছে।

বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের পাশাপাশি কয়েকটি ক্ষেত্রে তা ১২ শতাংশ করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।

এর আগে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে গত জুলাইয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তায় চায়। ঋণের শর্তের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গত ২৬ অক্টোবর আইএমএফের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ১৫ দিনের সফরে বাংলাদেশ আসে। প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। এরই মধ্যে পতিনিধিদলটি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনসহ (বিইআরসি) সরকারের বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

আইএমএফ এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের হিসাব নিয়ে আপত্তি তুলেছে। সংস্থাটির বক্তব্য হলো-কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখানো ৩৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বিনিয়োগকৃত প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে রিজার্ভের হিসাব করতে হবে। এছাড়া ব্যাংক খাতের সুশাসনের ঘাটতি, খেলাপি ঋণ, ঋণ ও আমানতের সুদহার বেঁধে দেওয়াসহ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা সম্পর্কেও সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চেয়েছে সংস্থাটি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) করহার বাড়ানো এবং কর অব্যাহতির সুবিধা তুলে নেওয়ার কথা বলেছে আইএমএফ। এজন্য করের আওতা বৃদ্ধি করে প্রান্তিক পর্যায়ে করদাতাদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে কর আহরণ করার কথা বলেছে। এছাড়া সক্ষমতা তৈরির জন্য এনবিআরকে সহায়তার প্রস্তাবও দিয়েছে আইএমএফ।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকির বিকল্প ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। ভর্তুকি বন্ধ করে বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন খরচ ও বিক্রির মধ্যে ঘাটতি কমাতে মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়েছে আইএমএফ। এর পরিবর্তে বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) হ্রাসের উপায়, বিপিডিবির আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব ও বিদ্যুতের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কেও জানতে চেয়েছে সংস্থাটি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের কিছু পণ্য আমদানিতে এখনো শুল্কহার বেশি। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের ট্যারিফ লাইন যৌক্তিক ও কাঠামোর সহজ করতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ট্যারিফ হার বেশি, যার গড় ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ডব্লিউটিওর হিসাব অনুযায়ী, তা ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। তা না হলে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর বাংলাদেশের রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একই সঙ্গে আইএমএফের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক এলএসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।

গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ পদ্ধতি জানতে চেয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। গতকাল রোববার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সঙ্গে বৈঠকে এ তথ্য জানতে চান প্রতিনিধিদলটির সদস্যরা। এ খাতের সার্বিক পরিস্থিতিও জানতে চেয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদানকারী সংস্থাটি।

ঋণ নিয়ে চলমান আলোচনার ধারাবাহিকতায় সফরের শেষ দিকে বিইআরসির সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ দল। বর্তমানে বিইআরসি বছরে এক কিংবা দুইবার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করে থাকে। আইএমএফ বলেছে, বারবার এটা করতে পারবে কি না। জবাবে বিইআরসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইন সংশোধন করা হয়েছে। ফলে কেউ আবেদন করলে তা করার সুযোগ আছে। এছাড়া মূল্য নির্ধারণের ফর্মুলা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। বিইআরসি বলেছে, সেবা খাতের জন্য ট্যারিফ নির্ধারণে সরকারের একটি নীতিমালা রয়েছে। সেটি অনুসরণ করা হয়। ভর্তুকি বিবেচনা নিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হয় বলে আইএমএফকে জানানো হয়।

গ্যাসের কী অবস্থা, কিভাবে গ্যাস সংগ্রহ করা হয়, সে বিষয়েও জানতে চেয়েছে আইএমএফ। বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। তবে বিদ্যুৎ-গ্যাসে ভর্তুকি নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানা হয়েছে। দেশের গ্যাস-বিদ্যুতের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি অবস্থানপত্র তুলে ধরা হয় বিইআরসির পক্ষ থেকে। বৈঠকে বিইআরসির চেয়ারম্যান আব্দুল জলিলসহ কমিশনের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

আজ সোমবার (৭ নভেম্বর) বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাদা বৈঠক করবে সংস্থাটি। ৯ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবে প্রতিনিধিদল। শেষ দিনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে তাদের বৈঠক করার কথা রয়েছে।