তাজরীন ট্রাজেডির এক দশক,এখনো শেষ করা যায়নি বিচার
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ঢাকা জেলাধীন আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এক দশক পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি বিচার।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ১১২ শ্রমিক।
বিচার শেষ না হওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে আদালতে সাক্ষী না আসা। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালত থেকে বারবার সমন দিলেও সাক্ষী আসছে না। এমনকি জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেও সাক্ষীদের আনা যাচ্ছে না আদালতে।
মামলাটি বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দিলারা আলো চন্দনার আদালতে বিচারাধীন। চার্জশিট দাখিলের পর ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। বিচার শুরুর সাত বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সাক্ষ্যগ্রহণে অগ্রগতি খুব সামান্য। রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। গত এক বছরে মাত্র দুজন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ৪ অক্টোবর মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। তবে ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষ কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির করতে পারেনি। তাই আদালত আগামী ১ জানুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিধ ধার্য করেছেন আদালত।
দেশের ইতিহাসে এটি অন্যতম ভয়াবহ ট্র্যাজেডির ঘটনায় ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) খায়রুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
মামলাটি তদন্তের পর ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খান ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।
চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, লোডার শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপার ভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও কোয়ালিটি ম্যানেজার শহীদুজ্জামান দুলাল।
এই ১৩ আসামির মধ্যে চারজন পলাতক এবং বাকি নয়জন জামিনে আছেন। পলাতক আসামিরা হলেন- মোবারক হোসেন মঞ্জু, রানা ওরফে আনারুল, শামিম মিয়া ও আল আমিন।
দীর্ঘ সময়েও মামলা শেষ না হওয়ায় বিচার ও ক্ষতিপূরণের আশা ছেড়ে দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। শ্রমিকরা অভিযোগ করছেন, সাক্ষ্য দিতে আদালতে গেলে তাদের হুমকি দিচ্ছেন গার্মেন্টসের মালিক দেলোয়ার ও তার স্বজনরা। তাই অনেক শ্রমিক পরিবারসহ আশুলিয়া এলাকা ছেড়ে দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ করছে, শ্রমিকরা সাক্ষ্য দিতে না আসায় মামলার বিচারেও অগ্রগতিও হচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী একেএমশাহ নেওয়াজ বলেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছি। রাষ্ট্রপক্ষ প্রতি ধার্য তারিখে সাক্ষীদের মোবাইল ফোনে এবং সমনের মাধ্যমে সাক্ষ্যর বিষয়ে তাদের জানায়। কিন্তু সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত না হওয়ার কারণে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন,আদালত থেকেও সাক্ষীদের হাজিরে বিভিন্ন ধরনের প্রসেস ইস্যু করেছে। ইতোমধ্যে ২৬ জন সাক্ষীর প্রতি জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তারপরও সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না। সাক্ষীরা মুখে বলে বিচার চাই, কিন্তু তারা আন্তরিক নন। বিচারের জন্য সাক্ষী দিতে আদালতে আসেন না। শ্রমিকরা আন্তরিক হলে তারা দলদ্ধভাবে আদালতে আসতো। প্রসিকিউশন সর্বত্রই সাক্ষীদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
এমতাবস্থায় মামলাটি নিষ্পত্তির বিষয়ে কত সময় লাগবে তা বলতে পারছেন না রাষ্ট্রপক্ষের ওই আইনজীবী।
তিনি বলেন, সাক্ষীরা দ্রুত আসলে ইচ্ছা করলে দুই মাসের মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা সম্ভব। সাক্ষ্যগ্রহণে যত বিলম্ব হবে, মামলা শেষ করতে ততোই সময় লাগবে।
অপরদিকে সাক্ষী হাজিরে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতায় আসামিরা হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে দাবি আসামিপক্ষের আইনজীবীদের। বিচার বিলম্বিত হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা। তাজরিনের মালিক দেলোয়ার হোসেন ও মাহমুদার আইনজীবী হেলেনা পারভীন বলেন, সাক্ষী না আসায় বিচার শেষ হতে বিলম্ব হচ্ছে। সাক্ষীরা অধিকাংশ গার্মেন্টস কর্মী। এজন্য ঠিকমত সাক্ষীদের খুঁজে পাচ্ছে না রাষ্ট্রপক্ষ। আবার অনেকেই আগের জায়গা ছেড়ে অন্যত্রে চলে গেছেন।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মামলাটি চলমান থাকায় আসামিদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। আসামিরাও বিচারপ্রার্থী। এমামলার জন্য তাদের প্রতি মাসেই আদালতে আসতে হয়। এর ফলে পারিবারিক, মানসিক, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। আমরাও ন্যায়বিচার চাই। আশা করছি, সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে আসামিরা এই মামলা থেকে খালাস পেতে পারেন।