সবচেয়ে দূষিত ঢাকার বাতাস
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: শীতকাল আগমনের পর থেকে বিপজ্জনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে ঢাকার বাতাসের দূষণমাত্রা। সহনীয় মাত্রার চেয়ে কখনো কখনো সাড়ে ছয় গুণ পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাচ্ছে দূষণ। চীনের উহান বা ভারতের নয়াদিল্লিকে পেছনে ফেলেছে ঢাকা। বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে কখনো প্রথম, কখনো দ্বিতীয় কখনো-বা তৃতীয় অবস্থানের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে ঢাকার মানদণ্ড। এই দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার ফলে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পতিত হচ্ছেন রাজধানীর বাসিন্দাগণ। হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ ও ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন বয়সের ও শ্রেণি-পেশার মানুষ।
বায়ুদূষণ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর বায়ুদূষণে ৮০ হাজার মানুষ মারা যায়। মানুষের গড় আয়ু তিন বছর কমছে। দূষণের কারণে বাড়ছে মানুষের বিষণ্ণতাও। যার অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির ৪ ভাগেরও বেশি। ঢাকায় সারা দিনে একজন যে পরিমাণে দূষিত বায়ু গ্রহণ করেন, তা প্রায় দুইটি সিগারেটের সমান ক্ষতি করে বলে এই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, কাশি, নিম্ন শ্বাসনালির সংক্রমণ এবং বিষণ্ণতার ঝুঁকি। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু, বয়স্ক এবং রোগে আক্রান্তরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা শ্বাস রোগে আক্রান্তরা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন বয়স্ক মানুষ, শিশু এবং যাদের ডায়াবেটিস ও হূদেরাগ আছে তারা। দূষিত এলাকার প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে শ্বাসকষ্ট। নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য বক্ষব্যাধিও এসব এলাকার বয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে দেখা গেছে।
গতকাল রবিবার বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম স্থান ছিল ঢাকা। এক দিন আগেও ছিল ১ নম্বর। গতকাল সকাল ৯টায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ৩৭৪ এবং বেলা ১১টায় স্কোর ৩৪৯ নিয়ে বাতাসের মান ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। পাকিস্তানের লাহোর ২২১ এবং ভারতের দিল্লি ২১০ একিউআই স্কোর নিয়ে যথাক্রমে তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে। ১০১ থেকে ২০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোরকে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর বলে চিহ্নিত করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান সূচক অনুসারে, শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত ‘ভালো’। ৫১ থেকে ১০০ ‘মোটামুটি’, ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত ‘সতর্কতামূলক’, ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই স্কোরকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর ৩০১-এর বেশি স্কোরকে ‘বিপজ্জনক’ বা দুযোগপূর্ণ বলা হয়। যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, দুই কারণে ঢাকার বায়ু বেশি দূষিত হচ্ছে। প্রথমটি হচ্ছে বাতাসের দূষিত উপাদান বাতাসেই রয়ে যাচ্ছে। শহরে বড় প্রকল্পের কাজ, নির্মাণাধীন ভবনের কাজ, যানবাহনের ধোঁয়ায় ঢাকার বায়ুর চাপ বেশি। এই দূষিত অংশ বায়ুর নিম্নস্তরে ২০০-৩০০ ফুট ওপরে অবস্থান করছে। ফলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, ঢাকায় বায়ুর মান সবচেয়ে বেশি খারাপ থাকে রাত ১টার দিকে। মধ্যরাতে বায়ূমানের সূচক থাকে গড়পড়তা (গ্যাসীয় ও কঠিন) ১৬২, যা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে বিবেচিত। দৈনিক গড় বায়ুমান সূচকে ঢাকায় দূষণ সবচেয়ে কম থাকে বিকাল ৪টার দিকে (সূচক ১২৫ বা ‘সতর্কতামূলক’); অর্থাৎ সর্বনিম্ন দূষণের সময়টাতেও বিশুদ্ধ বায়ু গ্রহণের সুযোগ নেই ঢাকাবাসীর। ঢাকায় বিকাল ৪টার পর দ্রুত বাড়তে থাকে দূষণ।
এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণের সমস্যায় জর্জরিত। এর বাতাসের মান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। গত এক সপ্তাহে বিশ্বের দূষিত শহরের মধ্যে ছয় দিনের অধিকাংশ দিন ঢাকা ছিল শীর্ষে। গবেষকেরা বলছেন, ঢাকার এমন বায়ু স্বাস্থ্যের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলছে। ফুসফুসের নানা রোগ, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিলতায় পড়ছে ঢাকাবাসী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জানিয়েছে, প্রতি বছর বাড়ছে দূষণ। বছরে গড় বায়ুদূষণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে—সাধারণত শীতের মৌসুমে গড় বায়ুদূষণ সূচক বাড়ে। জুন ও জুলাইয়ে বায়ুদূষণ কমে আসে। শীতকাল অপেক্ষাকৃত শুষ্ক ঋতু হওয়ায় এই সময়ে ধুলাবালির পরিমাণও বেড়ে যায়। এর সঙ্গে ইটভাটা ও সিমেন্ট কারখানা থেকে উত্পন্ন ধুলার মিশ্রণ ঘটলে আশঙ্কাজনকহারে বায়ুদূষণ বাড়ে। শীতে আর্দ্রতা কম থাকায় এই সময়ে বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলোর উপস্থিতিও বেড়ে যায়।
বায়ু দূষণ নিয়ে কাজ করা গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হচ্ছে ধুলাবালি। এসব ধূলিকণা মুখে গেলে মানুষ যত্রতত্র থুতু ও কফ ফেলে। তা আবার ধুলার সঙ্গে মিশে নানা মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকতে পারে। আরেকটি উৎস হচ্ছে কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানোর পাশাপাশি শহুরে যান্ত্রিকসহ নানা উৎস থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া ও ধুলা। এসব বাতাসে ক্ষুদ্র কণা ছড়ায়, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। গবেষকদের মতে, এসব বাদে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে ইটভাটা, শিল্পকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া এবং সড়ক ও ভবন নির্মাণসামগ্রী থেকে তৈরি ধুলা। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ মেট্রিক টন ধূলিকণা জমে। সেই হিসেবে প্রতি মাসে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধুলা জমার হিসাব পেয়েছেন গবেষকেরা। এই জমে থাকা ধুলা দিনের বেলা বাতাসের সঙ্গে মিশে যেমন দূষণ বাড়ায়, তেমনই রাতে গাড়ির অতিরিক্ত গতির সঙ্গে বাতাসে উড়তে থাকে। ফলে দিনের বেলার চেয়ে রাতের বেলায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। ঢাকার বায়ূর মান ডিসেম্বর মাস জুড়েই খারাপ অবস্থায় থাকে। আর জানুয়ারিতে এটি আরো খারাপ হয়। গত বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম ২২ দিনের মধ্যে ১৬ দিনই ঢাকার বায়ুর মান বিপজ্জনক ছিল। এমন অবস্থা চলতে থাকলে বায়ুদূষণ নিয়ে যেসব দেশ চিন্তিত, তারা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।