মাহি হাসান,দ্য রিপোর্ট : এক ধরনের লাইফসাপোর্টে বছর পার করলো দেশের পুঁজিবাজার। প্রায় পুরো বছরজুড়েই পুঁজিবাজারে বিরাজ করছে করুণ অবস্থা। লেনদেন নেমে এসেছে তলানিতে। অবস্থা এতোটাই ভয়াবহ ঠেকেছে লেনদেনের ঘর কোন ভাবে তিনশো কোটি টাকা পার হলেই এখন খুশি সবাই। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারবিমুখ হয়ে পড়ছেন। সেন্ট্রাল ডিপোজেটারি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্যমতে এ বছর জানুয়ারী মাসের ১১ তারিখ থেকে এই বছরের শেষ কার্যদিবস ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগাকারীদের বিও একাউন্টের পরিমান কমেছে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ২৮৪ টি বা ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ ।

 

সিডিবিএল সুত্রমতে, এই বছরের শুরুর দিকে ১০ই জানুয়ারী বিও হিসাবের সংখ্যা ছিলো ২০ লাখ ৩৬ হাজার ৫৮৫ টি। বছরের শুরু থেকেই কমতে থাকে এই সংখ্যা । বছরের মাঝামাঝি জুলাই মাসের ২৬ তারিখ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৯০ হাজার ৮১৬ । যা ছয় মাসে কমেছে ২৯ হাজার ৫১৫ টি। সর্বশেষ তথ্যমতে, বছরের শেষ কার্যদিবস ২৯ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিও একাউন্টের সংখ্যা ১৮ লাখ ৬১ হাজার ৩০১ টি।

সিডিবিএল হতে প্রাপ্ত ২৯শে ডিসেম্বরের হিসাবমতে, পুরুষ বিও একাউন্ট রয়েছে ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৮৯০ টি। যা জুলাই মাসের ২৬ তারিখ ছিলো ১৪ লাখ ৯ হাজার ১২৩ টি। বছরের শুরুতে , জানুয়ারী মাসের ১০ তারিখ ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৩৫২ টি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বরে পুরুষ বিও একাউন্টের পরিমান কমেছে ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৪৬২ টি অর্থ্যাৎ ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।

একই অবস্থা মহিলা বিও একাউন্টের হিসাবেও । বছরের শুরু থেকে অনেক কমেছে ডিসেম্বর মাসের বিও হিসাবের সংখ্যা। বছরে ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ বা ৫২ হাজার ৮০৫ টি কমেছে নারী বিও একাউন্টের সংখ্যা । ২৯ শে ডিসেম্বর নারী বিও একাউন্টের সংখ্যা ৪ লাখ ৫৫ হাজার ২৪ টি । যা জুলাই মাসের ২৬ তারিখ ছিলো ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৭৫১ টি। বছরের শুরুতে , জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখ ৫ লাখ ৭ হাজার ৮২৯ টি ছিলো নারী বিও একাউন্ট।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের এই তথ্যই বলে দিচ্ছে কতটা পুঁজিবাজারবিমুখ কতটা হয়েছে দেশের সাধারন মানুষ। অবশ্য এর পিছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মনে করেন একাধিক পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তীরা। পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বছর জুড়েই কৃ্ত্রিমভাবে বাজার রক্ষার চেস্টা করা হয়েছে। বাজারকে রক্ষা করতে দীর্ঘমেয়াদী কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এসব পদ্ধতিতে বাজার রক্ষা করা যায়না। বাজার রক্ষা করতে দরকার দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ। পলিসিগত পরিবর্তন আনলে বাজার আবার ব্যাক করবে মনে করেন এই পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ।

অন্যদিকে,ব্রোকারেজ হাউজগুলোও বলছে একই কথা। একাধিক ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা বলেন সারা বছর জুড়েই বিনিয়োগকারী কমেছে। অনেক পুরোনো বিনিয়োগকারী মার্কেট ছেড়ে চলে গিয়েছে । বিশেষ করে নাম এক প্রকাশে অনিচ্ছুক খুব পরিচিত এক ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন বছরের শেষ তিন মাস ছিলো সবচেয়ে কঠিন। লেনদেন বৃদ্ধি না পেলে বিনিয়োগকারী একদম তলানিতে নামবে। বাজার রক্ষা করতে এই মুহুর্তেই পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

রাজধানীর মতিঝিলে ইলিয়াস আমিন নামের এক বিনিয়োগকারীর সাথে তিনি দেশের পুঁজিবাজারে লেনদেন করছেন দুই যুগ ধরে। তিনি বলেন, বছরের শুরু থেকেই পুঁজিবাজার অনেকটা অস্থির ছিলো। বিএসইসির পক্ষ থেকে স্টাবল মার্কেটের কথা বলা হলেও বাজারকে স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়নি। এই বছর বাজারকে স্থির তো দূরের কথা, বেশিরভাগ সময় নিম্নমুখীই ছিলো। বাজার রক্ষা করতে এই মুহুর্তে বিএসইসি পদক্ষেপ নিবে বলে আশা করেন তিনি।

ডিএসই ওয়েবসাইটের প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক গত আড়াই বছরের সব রেকর্ড ভেঙ্গে যায় ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ। এর আগে গত এদিন ,দেশের প্রধান শেয়ারবজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মাত্র ১৯৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়। আগের সব নিম্নমুখীতার রেকর্ড এদিন ভেঙ্গে যায়। যদিও এর আগের কার্যদিবসে অর্থ্যাৎ ২২ শে ডিসেম্বর রেকর্ড ভেঙ্গেছিলো। সেদিন লেনদেন হয়েছিলো ২২৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকার শেয়ার। সাপ্তাহিক আর বড়দিন সহ তিনদিন মার্কেট ছুটির পর লেনদেন শুরুর প্রথম দিনই আবার ভাঙ্গে লেনদেন কমার রেকর্ড।

এদিকে, সিডিবিলের প্রাপ্ত তথ্যমোতাবেক , নিস্ক্রিয় বিও একাউন্টের হিসাব অনেকটা কমে এসেছে। ইতিবাচকতা লক্ষ্য করে গিয়েছে এই একটা প্যারামিটারে । ২০২২ সালের শুরুতে ১০ই জানুয়ারী নিস্ক্রিয় বিও একাউন্ট ছিলো ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৪ টি । এটি অনেকটা কমে এসেছে বছরে শেষের দিকে। সর্বশেষ ডিসেম্বর ২৯ তারিখের হিসাবমতে নিস্ক্রিয় একাউন্টের সংখ্যা ৭৬ হাজার ১ টি।

দেশের পুঁজিবাজারের তথ্যকোষ সিডিবিএলের তথ্যমতে কমে গেছে একক বিও হিসাবের সংখ্যাও । ১০ই জানুয়ারির হিসাবমতো যৌথ হিসাবের সংখ্যা ছিলো ১৩ লাখ ৭৬ হাজার ২১ টি। যা বছরের মাঝামাঝি ২৬শে জুলাই কমে দাঁড়ায় ১২ লাখ ৯৫ হাজার ৪৮৮ টি। সর্বশেষ, ২৯শে ডিসেম্বরের হিসাব মতে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৪২৪ টি। যৌথ বিও হিসাবের সংখ্যা বছরের মধ্যে কমেছে ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ।

অন্যদিকে যৌথ বিও একাউন্টের সংখ্যা প্রায় ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ১০ই জানুয়ারি ছিলো ৬ লাখ ৪৫ হাজার ১৬০ টি। বছরের মাঝে ২৬ শে জুলাই এই সংখ্যা কমে এসেছে ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৩৮৬টি। বছরের শেষে এসে ২৯শে ডিসেম্বর দাঁড়ায় ৫ লাখ ৬১ হাজার ৪৯০ টি।

দেশের পুঁজিবাজারে স্থানীয় বিনিয়োগকারির পাশাপাশি কমেছে বিদেশী বিনিয়োগকারির বিও একাউন্ট সংখ্যা। বছরের শেষেও ২৯শে ডিসেম্বরের হিসাবে স্থানীয় বিনিয়োগকারীর একাউন্ট সংখ্যা ১৭ লাখ ৮১ হাজার ৭৯৭ টি । অন্যদিকে বিদেশী বিনিয়োগকারীর একাউন্ট সংখ্যা হচ্ছে ৬৩ হাজার ১১৭টি টি।

বছরের মাঝামাঝি ২৬শে জুলাই স্থানীয় বিনিয়োগকারীর হিসাব সংখ্যা ছিলো ১৮ লাখ ৮ হাজার ৩৩৭ টি। অন্যদিকে বিদেশী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিলো ৬৬ হাজার ৫৩৭ টি।

বছরের শুরুরদিকে এই সংখ্যা দুইটি ছিলো অনেক বেশি। সিডিবিএলের তথ্যমতে ১০ই জানুয়ারি দেশের স্থানীয় বিনিয়োগকারীর একাউন্ট সংখ্যা ছিলো ১৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৩০ টি এবং বিদেশী বিনিয়োগকারির বিও হিসাবের সংখ্যা ছিলো ৮৬ হাজার ৩৫১ টি।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, বছরজুড়ে স্থানীয় বিনিয়োগকারী বিও হিসাব সংখ্যা কমেছে ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ । পাশাপাশি প্রায় ২৬ দশমিল ৯০ শতাংশ কমেছে বিদেশীদের বিও একাউন্ট।

(মাহা/দ্য রিপোর্ট/২৯শে ডিসেম্বর)