সীমান্তে হত্যা থামছেই না
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: মাত্র তিন দিন আগের কথা। গত ২৯ ডিসেম্বর রাতে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার বড়খাতা ইউনিয়নের দোলাপাড়া সীমান্তে ‘বিএসএফ’র গুলিতে সাদিকুল ইসলাম সাদিক ও নাজির হোসেন নামের দুই বাংলাদেশি নিহত হন। এর তিন দিন পরই নতুন বছরের প্রথম দিন রোববার ভোরে সেই লালমনিরহাটের পাটগ্রামে বিএসএফের গুলিতে বিপুল হোসেন (২০) নামের আরেক বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যু হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, সদ্য বিদায়ি বছর ২০২২ সালে বিএসএফের গুলিতে, নির্যাতনে ও ধাওয়ায় ২৩ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। যার মধ্যে কেবল গুলিতেই নিহত হয়েছে ১৬ জন। এ ছাড়া বিগত ৬ বছরে নিহত হয়েছে ১৭৩ জন।
অথচ বছরে কয়েক দফায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সম্মেলন আয়োজন করে আনুষ্ঠানিকভাবেও সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোটায় আনার বিষয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রতিশ্রুতি কেবল মুখে মুখেই রয়ে গেছে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, অপরাধ থাকলে আইনের আওতায় না এনে সরাসরি হত্যার মতো ঘটনায় চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। সেই সঙ্গে এই ধরনের অরাজকতাও প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এ অবস্থায় সীমান্তে হত্যা বন্ধে ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২২ সালে বিএসএফের হাতে ২৩ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। যার মধ্যে বিএসএফের গুলিতে নিহত ১৬ জন, নির্যাতনে হত্যা ৪ জন, বিএসএফের ধাওয়ায় মৃত্যু ২ জন এবং মৃত্যুর ধরন উল্লেখ নেই এমন ১ জন নিহত হয়। এ ছাড়া তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে মোট ১৮ জন বাংলাদেশি বিএসএফের হাতে হত্যার শিকার শিকার হন। যাদের মধ্যে গুলিতে হত্যা করা হয় ১৬ জনকে। তার আগে ২০২০ সালে সীমান্তে বিএসএফের হাতে মোট ৪৯ জন নিহত হন। যাদের মধ্যে গুলিতে ৪২ জন এবং নির্যাতনে হত্যা ৬ জন এবং ধরন উল্লেখ নেই এমন ১ জন নিহত হয়েছে।
২০১৯ সালে সীমান্তে ৪৩ বাংলাদেশি হত্যার শিকার হয়। যাদের মধ্যে গুলিতে হত্যার শিকার হয় ৩৭ জন। অন্যদিকে ২০১৮ সালে মোট নিহত ১৫ জন, যার মধ্যে গুলিতে হত্যা ৮ জন, নির্যাতনে ৬ জন এবং মৃত্যুর ধরন উল্লেখ নেই এমন ১ জন নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৭ সালে সীমান্তে মোট ২৫ জন বাংলাদেশি বিএসএফের হাতের নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে গুলিতে হত্যা ১৮ জন এবং নির্যাতনে ৭ জন।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে ‘হোয়াটসঅ্যাপে’ যোগাযোগ করা হয় ভারতের ‘মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’র সম্পাদক কিরীটী রায়ের সঙ্গে। ভারতীয় এই মানবাধিকারকর্মী সময়ের আলোকে বলেন, ‘সীমান্তে আন্তর্জাতিক যে আইন আছে সেটা বিএসএফের পক্ষ থেকে মানা হচ্ছে না। আমি নিজেও ভারতে বাস করি। এখানে (ভারতে) আইন আছে, সংবিধবান আছে। যেখানে বিদেশিদের নিরাপত্তার জন্য বিধানও আছে। কিন্তু সেগুলো মানা হচ্ছে না। বিএসএফ প্রধান হলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবার প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। তো সেখানেই সীমান্তে হত্যা বন্ধ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দীর্ঘদিন ধরে মতবিরোধ বা কথা চালাচালি হচ্ছে। এ ছাড়া বিগত সময়ে ফেলানী হত্যাসহ অনেক হত্যাকা-ের ঘটনায় দেখা গেছে সেভাবে বিচার হয়নি। ফলে সেই বিচারহীনতার কারণেও সীমান্তে হত্যা বেড়েছে।’
প্রখ্যাত এই মানবাধিকারকর্মী কিরীটী রায় আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, সীমান্তে হত্যা বন্ধে ভারতকে চাপ দিতে হবে। যেকোনো মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করা না গেলে সীমান্তে হত্যা শতভাগ বন্ধ হবে না।’
গতকাল ভোরে লালমনিরহাটে একজন নিহত হলেও এ অঞ্চলের সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় গত ২ মাসে বিএসএফের গুলি-নির্যাতনে অন্তত ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বর রাতে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা ইউনিয়নের দোলাপাড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে সাদিকুল ইসলাম সাদিক ও নাজির হোসেন নামের দুই বাংলাদেশি নিহত হন। এর আগে গত ৯ নভেম্বর জেলার আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ি সীমান্তে ভারতীয় গরু আনতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হন ওয়াসকরুনী ও আয়নাল হক নামের দুই বাংলাদেশি। অন্যদিকে গত ২৭ নভেম্বর হাতীবান্ধার টংভাঙ্গা ইউনিয়নের গেন্দুকড়ি সীমান্তে বিএসএফের নির্যাতনে নিহত হন সাদ্দাম হোসেন নামের এক গরু ব্যবসায়ী। এ ছাড়া গত ১৪ ডিসেম্বর পাটগ্রাম উপজেলার শ্রীরামপুর সীমান্তে বিএসএফের নির্যাতনে নিহত হন ভারতীয় এক গরু ব্যবসায়ী। তার এক দিন পর ১৫ ডিসেম্বর ওই উপজেলায় বিএসএফের নির্যাতনে শাহাদাত হোসেন নামের এক গরু ব্যবসায়ী নিহত হন।
অন্যদিকে সীমান্তে একের পর এক বাংলাদেশিকে হত্যার বিষয়ে রোববার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মুখপাত্রসহ একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।
তবে গত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের আগরতলায় অনুষ্ঠিত সীমান্ত সম্মেলনে সীমান্তে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা ও নির্যাতন শূন্যের কোটায় আনার বিষয়ে বরাবরের মতোই একমত হয়েছিল বিজিবি ও বিএসএফ। ভারতের আগরতলায় অনুষ্ঠিত বিজিবির রিজিয়ন কমান্ডার এবং বিএসএফের ফ্রন্টিয়ার আইজি পর্যায়ের তিন দিনব্যাপী সীমান্ত সম্মেলনের শেষ দিনে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। যদিও তার আগেও একাধিকবার সীমান্ত সম্মেলনে একই ধরনের সিদ্ধান্ত ও সমঝোতার কথা বলা হলেও সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা বা নির্যাতন বন্ধ হয়নি, বরং প্রতিনিয়তই বেড়েই চলেছে বলে জানা যায়।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন সময়ের আলোকে বলেন, ‘সরকারের উচ্চমহলে তথা বিজিবি ও বিএসএফের উচ্চ পর্যায়ে বারবার সীমান্তে হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতি, আলোচনা এবং সমঝোতা হলেও কার্যকর কিছুই হচ্ছে না। হত্যা কমছে না, বরং প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। এ অবস্থায় জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ দেখি না। স্বাভাবিক আলোচনায় সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে না।’