তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু:  দেশের পুঁজিবাজারে সাধারণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণের পরিমাণ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছে ধোঁয়াশা। এ বিষয়ে সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারেন নি। অনেকে বলে আসছিলেন পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ ৮০ শতাংশ , কেউবা বলছিলেন এর পরিমাণ পঞ্চাশ শতাংশ। কেউ বা আরো কম।

কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এসব আলোচনার কোনো ভিত্তি খুজে পাওয়া যায়নি। দেখাগেছে সাধারণ বা ব্যক্তি শ্রেণীর আঠারো লাখ বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ মাত্র উনিশ শতাংশ। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে কারসাজিকারীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য সব ধরণের বিনিয়োগকারীদের সমান অংশগ্রহণ জরুরী। শেয়ারধারণের সঠিক পরিমাণ বের করতে তৎপরতা চালায় দ্য রিপোর্ট। তাতে দেখা গেছে শেয়ারধারণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ মাত্র ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৯১৪ বিও একাউন্টধারী ব্যাক্তিশ্রেণীর বিনিয়োগকারীর ধারণকৃত শেয়ারের বাজার মূল্য তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির শেয়ারের বাজার মূল্যের মাত্র ১৯ শতাংশ। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ ২০ শতাংশ। কোম্পানির উদ্যেক্তা পরিচালকদের অংশগ্রহণ ৫৭ শতাংশ।

দ্য রিপোর্টের পক্ষ থেকে ইলেক্ট্রনিক্স শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরী অব
বাংলাদেশ লিমিটেডের( সিডিবিএল) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ব্যক্তিশ্রেনীর বা সাধারণ বিনিয়োগকারী, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী , উদ্যেক্তা পরিচালক , সরকারি ও বিদেশী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ও তাদের শেয়ারধারণের সংখ্যা ও সেসব শেয়ারের বাজার মূল্যের হিসেব জানতে চাওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে সিডিবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুভ্র কান্তি চৌধুরী বলেন এ ধরনের তথ্য সিডিবিএল সংরক্ষণ করে না। এরপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগযোগ করা হয়। বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করিয়ে দেন। কিন্তু সেই বিভাগ থেকে এক মাসেও কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে দ্য রিপোর্টের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ সেল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইট থেকে সমস্ত ডাটা সংগ্রহ ও সংযুক্ত করে।

এভাবে পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী, প্রতিষ্ঠাানিক বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা পরিচালক, সরকারি
প্রতিষ্ঠান ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণের অনুপাত বের করা হয়। ২০২২ সালে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগৃহিত এ তথ্যে দেখে গেছে পুঁজিবাজারে মোট ৩৯৪টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে। যার মোট শেয়ার সংখ্যা ৯ হাজার ৮১ কোটি ৫৫ লাখ ৯ হাজার ২৮২টি। ২৯ ডিসেম্বর যার বাজার মূল্য ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। এই শেয়ারের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকা শেয়ারের পরিমাণ ৩১.২৪ শতাংশ বা ২ হাজার ৮৩৭ কোটি ১৯ লাখ ২২ হাজার ৯৩৪টি। যার বাজার মূল্য ছিলো ৮৫ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। মোট বাজার মূল্যের যা ১৯.৩১ শতাংশ। বিপরীতে ওই সময় কোম্পানির উদ্যেক্তা পরিচালকদের হাতে ছিলো ৪২ দশমিক ৯৬ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯০১ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার ৬২৩টি শেয়ার। এসব শেয়ারের বাজার মূল্য দাড়ায় ২ লাখ ৫৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা বা ৫৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। একই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ছিলো ২০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বা ৮৬৯ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ৮৯ টি শেয়ার। এসব শেয়ারের বাজার মূল্য দাড়িয়েছিলো ৭০ হাজার ৬০১ কোটি টাকা।


অন্যদিকে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে থাকা শেয়ারের পরিমাণ ছিলো ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ বা ২৮৯ কোটি ৯৭ লাখ ৭৬ হাজার ৪৪৯টি শেয়ার। যার বাজার মূল্য ছিলো ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ বা ১৬ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। পাশাপাশি এসময় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের হাতে ছিলো ২ দশমিক শুন্য ২ শতাংশ শেয়ার বা ১৮৩ কোটি ৪৪ হাজার ৮৯ হাজার ১৮৮টি শেয়ার। এসব শেয়ারের বাজার মূল্য ২৯ ডিসেম্বর ছিলো ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ বা ১৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।

ডিএসই ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত অনেকগুলো কোম্পানি নিয়ে পর্যালোচনা করা দ্য রিপোর্ট। দেখা যায়
বেশিরভাগ কোম্পানিরই একই অবস্থা। ব্যাংকিং খাতের পুরোনো কোম্পানি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের দেখা যায় কোম্পানির পরিচালকদের হাতে থাকা শেয়ারের সংখ্যা ৩০ দশমিক ৬৭। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারির হাতে থাকা শেয়ারের সংখ্যা ৪৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ ।বিদেশি বিনিয়োগকারি রয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারি রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারির অর্ধেকেরও কম।

যদিও সিডিবিএলের প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিও একাউন্টের হিসাবের অনেক এগিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিরা। ২৯ শে ডিসেম্বরের হিসাবমতো একক এবং যৌথ বিও একাউন্টের সংখ্যা ছিলো ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৯১৪ টি । অন্যদিকে,একইদিনে প্রাতিষ্ঠানিক বিও একাউন্টের সংখ্যা ছিলো ১৬ হাজার ৩৮৭ টি। বোঝা যাচ্ছে যে বিও একাউন্ট বেশি থাকা স্বত্বেও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিদের অংশগ্রহণ দিন দিন কমেই যাচ্ছে ।

শেয়ারধারণের এই অনুপাতকে ভারসাম্যহীন বলে মন্তব্য করেছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে সব ধরনের বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ সমান না হলে বাজার গতিশীল হয় না। এ ধরনের বাজার ব্যবস্থাপনায় কারসাজিচক্র শক্তিশালী হয়ে উঠে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ন্ত্রন শিথিল হয়ে পড়ে। ফলে
কারসাজিকারীদের এক লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয় বাজার। তবে ফ্লোর প্রাইস শেয়ারবাজারে সব স্বাভাবিক
অবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়ে এক দীর্ঘ বন্ধ্যাত্বে পড়েছে,যার খেসারত সকলকেই দিতে হচ্ছে বলে মনে করেন
তারা। এই বন্ধ্যা পরিস্থিতিতে শেয়ার ধারণের অনুপাত দিয়ে কোনো লাভ হবে না বলেই মনে করেন
বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী দ্য রিপোর্টকে বলেন, বাজারে সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের সমান অংশগ্রহণ দরকার। নইলে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বেশী না হলে তারা ক্রীড়ানক হয়ে যান। তিনি বলেন এখনতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীও ডে-ট্রেডারের ভূমিকায় নেমেছে। ফলে বাজার গতি ফিরে পাচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন,
ফ্লোর প্রাইস না উঠালে কে বেশী বিনিয়োগ করলো আর কে কম বিনিয়োগ করলো তাতে লাভ হবে না।
বিদেশী বিনিয়োগকারীরা চলে যাচ্ছে। আর ক্ষুদ্র বিনিয়োগাকারীদের দুটি ভাগ হয়ে গেছে একাংশ সরাসরি গেম্বলিং এ জড়িয়ে পড়ছে। অন্য অংশ ডে-ট্রেডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের যে হিসেব দেখলাম তাতে হতাশ। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ না বাড়লে বাজারের বন্ধ্যাত্ব ঘুচবে না। আর ফ্লোর প্রাইস না তুলে দিলে তাদের সংখ্যাও বাড়বে না।

(দ্য রিপোর্ট / টিআইএম/ ছাব্বিশ ফেব্রুয়ারি,২০২৩)