অজানা এক মুক্তিযোদ্ধার গল্প
আজ ২৬ মার্চ, ৫৩তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের সূচনার এ সময়টি জাতি নিবিড় আবেগের সঙ্গে স্মরণ করে।রাজধানীসহ সারা দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে পালিত হচ্ছে মহান স্বাধীনতা দিবস। একই সঙ্গে বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের। এমনই এক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম। পেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানি স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সনদ।
যদিও পরে সেই সনদ হারিয়ে যাওয়ায় আর আবেদন করেননি। ফলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নামও উঠেনি। যুদ্ধের আগে এবং পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অসংখ্য বার দেখা করেছেন আব্দুর রহিম। বঙ্গবন্ধুর খুব কাছ থেকে আওয়ামী লীগের একজন সংগঠক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন নিবিড়ভাবে। তিনি ছিলেন পাকিস্তান রেলওয়ের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। মুক্তিযুদ্ধের সময় তোফায়েল আহমেদ, ড.কামাল হোসেন সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে তাঁর। একাত্তুর সালে বয়স ছিল চল্লিশ। আজ বিরানব্বই বছর বয়সে মনে করতে পারেন না অনেক কিছু। তবে ২৫ মার্চের সেই ভয়ংকর স্মৃতির কথা এখনো মনে আছে। সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল না তেমন, তখনকার ঢাকা শহর থেকে চার মাইল দূরে তাঁর নিজ বাড়ি সবুজবাগে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প গঠন ও তাদের নয় মাস পর্যন্ত থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সে সময় ডেমরা কায়েতপাড়া এলাকায় আশ্রয় নেওয়া মানুষের কাছে আব্দুর রহিম ঠিকাদার ছিলেন জনদরদী এক নেতার নাম। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। আমরা সবসময় শুনি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প । চলুন আজ শুনি মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে রসদ যোগানো এক যোদ্ধার গল্প।কথার শুরুতেই দেশের মানুষের প্রতি স্বাধীনতার শুভেচ্ছা জানান আব্দুর রহিম। স্বাধীনতার এই দিনে আব্দুর রহিম ঠিকাদারের সাথে কথা বলেছেন দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু। সঙ্গে ছিলেন স্টাফ রিপোর্টার মাহি হাসান।
দ্য রিপোর্ট : স্বাধীনতার বয়স ৫২ পেরিয়েছে আজ। কেমন লাগছে আপনার ?
আব্দুর রহিম : খুবই সুখের এক অনুভূতি আমার। আমার মতো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষদের জন্য দিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
দ্য রিপোর্ট : যুদ্ধের সময় কী ছিল আপনার কর্মকাণ্ড?
আব্দুর রহিম : আমি ছিলাম রেলওয়ের ঠিকাদার। মোটামুটি ভালো বিত্তবান ছিলাম। সে কারণেই মুক্তিযোদ্ধাসহ আশ্রয় নেওয়া সাধারণ মানুষের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমাদের প্রভাব ছিল গ্রামে। তৎকালীন সবুজবাগ থানার বেগুনবাড়ি গ্রামের আমার বাড়িটা হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প । তাদের সব ধরনের সাহায্য করেছি। নয় মাস তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। যুদ্ধের পুরোটা সময় গ্রামের প্রতিটি পরিবারকে সময়টা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
দ্য রিপোর্ট : ২৫ মার্চ ভয়ংকর সেই রাতে আপনি কোথায় ছিলেন ? কেমন ছিল সেই রাত?
আব্দুর রহিম : সেদিন আমি আমার মাদারটেকের পাকা বাড়িতে রাতে বন্ধুদের আড্ডা শেষে ঘরে ঢুকেছি। কিছুক্ষণ আগে আড্ডা ছেড়ে যাওয়া আমার এক বিয়াইয়ের ডাকে দরজা খুলি। খুলতেই সে জানালো চারদিকে গুলাগুলি শুরু হয়েছে। ছাদে উঠে দেখি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবিরত গুলি হচ্ছে। আগুনের গোলা যেন আমাদের দিকে ছুটে আসছে। সারারাত বোমা আর গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। ভয়ংকর ছিল সেই রাত । ছাব্বিশে মার্চ দিনে ঢাকা শহর ছেড়ে লোকজন আমাদের গ্রামের দিকে আসতে শুরু করলো। ছাব্বিশে মার্চ রাতেও ভয়াবহ অবস্থা। কিছুদিন পরে সবুজবাগ থানার বেগুনবাড়িতে নিজেরই গ্রামে চলে যাই । সেখানে দলে দলে শহুরের লোকজন নারী পুরুষ শিশু আশ্রয় নিতে শুরু করে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে কাজ শুরু করি। প্রতিটি বাড়িতে চার পাঁচজন করে যুবককে পাহারায় নিয়োগ করি, যাতে নারী বা শিশু কিশোরীদের কোনো ক্ষতি না হয়।
দ্য রিপোর্ট : মুক্তিযুদ্ধের আগে বা পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আপনার ?
আব্দুর রহিম : অসংখ্যবার । বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হবার সাত দিনে আগেও দেখা করেছি। রুটিন করেই সকাল বিকাল ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে যাওয়া হতো। আমরা চারজন যেতাম। আমি সহ আমার আরো তিন বন্ধু। এলাকায় আমরা আওয়ামী লীগের সংগঠক ছিলাম। বঙ্গবন্ধু তখন প্রায়ই ডেমরার দিকে আসতেন। নানা সাংগঠনিক কার্যক্রমে তখন দেখা ও কথা হতো। অনেকবারই তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে ।
দ্য রিপোর্ট : ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরুর আগে বঙ্গবন্ধু কি বলতেন ? কিভাবে আপনাদের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন ?
আব্দুর রহিম : বঙ্গবন্ধু তখন বলতেন "এই আর কিছুদিন পর আমাদের অধিকার আমরা ফিরে পাবো। তোদের নিজেদের যা আছে তা দিয়ে হলেও দাবি আদায় করবো। যা কিছু বিসর্জন দেয়া লাগবে দিবি। তোরা প্রস্তুতি নে ।এই ধরনের নানা কথা বলে আমাদের সাহস যোগাতেন । আমরা তো অস্থির হয়ে পড়েছিলাম।
দ্য রিপোর্ট : ৭ মার্চ কোথায় ছিলেন? রেসকোর্স ময়দানে সেই ভাষণ শুনেছিলেন ?
আব্দুর রহিম : অবশ্যই। আমরা তো মিছিল নিয়ে গেছিলাম। যদিও সেদিন স্টেজে যেতে পারিনি। এতো মানুষ আগে একসাথে আমি কখনো দেখিনি। পিছনে দাঁড়িয়ে শুনার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেদিনই আমরা প্রথম পেয়েছিলাম দিক নির্দেশনা। সেদিন তো তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।
দ্য রিপোর্ট: স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এখন নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ক শোনা যাচ্ছে। আপনার মত কী ?
আব্দুর রহিম: স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষণা আমরা পেয়েছিলাম ৭ মার্চ। সেদিনই আমরা শুনেছিলাম "তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দিব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম "। একথার মাধ্যমেই আমরা নির্দেশনা পেয়েছিলাম যুদ্ধের। এরপরে ২৫শ মার্চ ভয়ংকর রাতের পরে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বলে শুনেছি। তবে নিজে সে ঘোষণা শুনিনি। মানুষের মুখে শোনা ।
দ্য রিপোর্ট: আপনি বলেছিলেন আপনার মুক্তিযোদ্ধা সনদ ছিল। কোন সেক্টর কমান্ডার থেকে সে সনদ আপনি হাতে পেয়েছিলেন ?
আব্দুর রহিম: আমি মেজর এ টি এম হায়দার সাহেবের কাছ থেকে পেয়েছিলাম । যিনি দুই নম্বর সেক্টরের সহ অধিনায়ক, পরবর্তীতে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন । সেখানে এম এ জি ওসমানী সাহেবের স্বাক্ষর ছিল। সেটা হারিয়ে গেছে । আমার মেয়ে একদিন স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। সে হারিয়ে ফেলে। আমি আর সে সার্টিফিকেট তুলিনি। চেষ্টাও করিনি। আমি সার্টিফিকেট দিয়ে কী করবো? আমার তো ধান্ধা নেই।
দ্য রিপোর্ট: মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময় কেমন চলেছে দেশ?
আব্দুর রহিম: মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশদ্রোহী কিছু মানুষ সুযোগে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন সোনার বাংলা গড়তে । কাজ শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ করে যেতে পারেননি।
দ্য রিপোর্ট: ৫২ বছর আগে দেশ নিয়ে কী ভেবেছিলেন এবং ৫২ বছর পর কী দেখছেন?
আব্দুর রহিম: দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এতো কিছু বলতে পারিনা । আমি শুধু চাই দেশ ভালো থাকুক । আমার মতো মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছে তাঁরা ভালো থাকুক।
দ্য রিপোর্ট : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আব্দুর রহিম: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/ মাহা/২৬ মার্চ,২০২৩)