পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত সিমটেক্সের শেয়ারহোল্ডাররা
মাহি হাসান, দ্য রিপোর্ট: পুঁজিবাজারের বস্ত্র খাতের কোম্পানি সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তন নিয়ে একের পর এক নাটকীয়তা চলছে। সর্বশেষ গত বুধবার (২২শে মার্চ) পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে চেয়ারম্যানসহ নতুন ৫ জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। প্রশ্ন উঠেছে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেওয়ার আইনী এখতিয়ার নিয়ে। বিএসইসি যদি পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন পরিষদ গঠন করে দেওয়ার এখতিয়ার চালু রাখে তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মালিকদের মধ্যে মালিকানা ধরে রাখা নিয়ে ভীতি ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের একটি সুত্রে জানা গেছে দুর্নীতির দায়ে পদ হারানো কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ অনেকদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছিলো পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে নিজের দখল ফিরে পাওয়ার। বাইশে মার্চের পরিষদ পুনর্গঠন তারই ফসল। তবে এতে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকিতে পড়েছেন। কোম্পানিটির বর্তমান পর্ষদের হাত ধরে বিভিন্ন প্রতিকুল পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক মন্দাকে মোকাবেলা করে ব্যবসা এগিয়ে যাচ্ছিলো। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের চলমান সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতির মধ্যেও সিমটেক্সে বিনিয়োগকারীদের ৮% নগদ মুনাফা দিয়েছিলো। কিন্তু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় কোম্পানির অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য দেখেই। গত বছর ২৪ টাকায় লেনদেন হওয়া শেয়ারটি এখন লেনদেন হচ্ছে ১৪ টাকায়।
সিমটেক্স ইন্ড্রাস্ট্রিজ নিয়ে আলোচনার শুরু গত বছরের ১৭ই আগস্ট। সেদিন অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় কোম্পানিতে নানা অনিয়মের কারণে লে. ক. (অবঃ) মো. আনিসুর রহমানকে চেয়ারম্যানের পদ হতে অব্যহতি প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। স্বতন্ত্র পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মো. সরোয়ার হোসেন-এর নাম নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে প্রস্তাব করা হয় যা সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারহোল্ডারদের ভোটে পাশ হয়। পরবর্তীতে আনিসুর রহমান চেয়ারম্যান হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় ই-মেইল দিয়ে কোম্পানিকে সহযোগিতা না করার জন্য অনুরোধ করেন বলে কোম্পানি সুত্রে জানা গেছে । দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সাবেক এই চেয়ারম্যান এখানেই থেমে থাকেননি। তাঁর নেতৃত্বে গত বছরের ৩১ আগস্ট অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা ফ্যাক্টরিতে আক্রমণ চালায়। এসময় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হত্যার হুমকি দেয়। তারা শ্রমিকদের অতর্কিতভাবে মারধর করে এবং গুলি চালায়। এতে কারখানার ফ্লোর ইনচার্জ রিপন শেখ, ড্রাইভার রফিক, ট্রান্সপোর্ট অফিসার জাহাঙ্গীর, সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার, শ্রীনিবাসা রাও তাল্লোরীসহ অনেকে আহত হন। পরে সাভার মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ৫টি শটগান, ৩৭ রাউন্ড গোলাবারুদ, একটি বিদেশি পিস্তলসহ আনিসুর রহমান ও আরও ৭ জনকে আটক করে। বাইশে ডিসেম্বরের এজিএমের মাধ্যমে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ভোটে পরিচালক পদ থেকে অবসর দেওয়া হয় আনিসুর রহমানকে। তার স্থলে নাজমুস সাকিব যুগভেরী মনোনিত পরিচালক হিসেবে শেয়ারহোল্ডার ভোটে নির্বাচিত হন। ওই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর আনিসুর রহমান জামিনে মুক্ত হয়ে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা দায়েরের চেষ্টা করেন। তবে থানা মামলা নিতে সম্মতি না হলে কোর্টে এজাহার দায়ের করেন আনিসুর রহমান। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়াজ রহমান সাকিব, হেড অফ কর্পোরেট এ্যাফেয়ার্স জনাব মো. জাহিদ, কোম্পানির সচিব আশিষ কুমার সাহা ও কোম্পানির সহকারী ম্যানেজার পরিমল চন্দ্র পালকে আসামী করা হয়। এতেই থেমে থাকেননি তিনি। নামে বেনামে সিমটেক্সের বর্তমান ম্যানেজমেন্টের সাথে জড়িতদের নামে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নপ্রান্তে অর্ধডজন হয়রানিমুলক মামলাও দিয়েছেন। যদিও ইতিমধ্যেই তার দায়ের করা একাধিক মিথ্যা মামলা তদন্ত শেষে পুলিশ সিমটেক্স কতৃপক্ষকে অব্যাহতি দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে সাভার মডেল থানায় মামলা দায়ের করে। (সাভার মডেল থানার মামলা নং-০৪, তারিখ ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ধারাঃ ১৯অ/১৯(ভ) ১৭৭৮ সালের অস্ত্র আইন)। এছাড়া সিমটেক্স ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃক দায়ের করা মামলা (সাভার মডেল থানার মামলা নং-০৩, তারিখ ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ধারাঃ ১৪৩/৪৪৭ /৪৪৮/৩২৩/ ৩২৫/৩২৬/ ৩০৭/১১৪/ ৫০৬/৩৪ পেনাল কোড), কারখানায় হামলায় গুরুত্বরভাবে আহত রিপন শেখ এর পরিবারের দায়েরকৃত মামলা (ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত, বাগেরহাট মিস কেস নং ২৯০/২২) এবং সিমটেক্স ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃক দায়ের করা আর্থিক জালিয়াতি/দূর্নীতি মামলা (যুগ্ন জেলা জজ আদালত, ঢাকা মামলা নং ০৭/২৩ তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) চলমান।
এছাড়া অব্যাহতির পর থেকে আনিসুর রহমান কারখানার কার্যক্রম বিঘ্নিত করতে ব্যাংক, বিএসইসি,কাস্টমস, চিটাগাং পোর্টসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে মিথ্যা,বানোয়াট ও অসত্য তথ্য সরবরাহ করেন বলে অভিযোগ করছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। এর মাধ্যমে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারের ক্ষতি করার চেষ্টা করেন। চাকরি করে কোম্পানিটির মালিকের দেওয়া ২ শতাংশ শেয়ার পেয়ে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন আনিসুর রহমান। এতশত অভিযোগ স্বত্তেও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কিভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান, সে প্রশ্ন তুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানি এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিএসইসি সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের পর্ষদ পূণ:গঠন করেছে সাবেক চেয়ারম্যানের অভিযোগের ভিত্তিতে। প্রসঙ্গত, গত বুধবার (২২ মার্চ) বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাউত-উল-ইসলামের স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনা জানানো হয়, "সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ আইন, ১৯৬৯ অধ্যাদেশ এর ২০ এ ধারা অনুযায়ী সিমটেক্স ইন্ডাষ্ট্রিজের বর্তমান স্বতন্ত্র পরিচালক মো. আকরাম হোসেন এবং শাহ মো. আসাদ উল্লাহ, মনোনীত পরিচালক শরীফ শহিদুল ইসলামের পরিবর্তে ইস্যুকারী পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানকে কোম্পানির বিদ্যমান পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে"। নতুন পাঁচ স্বতন্ত্র পরিচালকরা হলেন- পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) শেখ মামুন খালেদ। অন্যরা হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সুবোধ দেবনাথ, দ্য জুরিস্ট ঢাকা বাংলাদেশের পাটনার কাওসার আহমেদ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল কাইয়ুম, ব্যবসায়ী আবিদ আল হাসান। এই ৫ জন স্বতন্ত্র পরিচালকের মধ্য থেকে শেখ মামুন খালেদকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
যদিও এই পরিস্থিতি নিয়ে কোম্পানির একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন ভিন্ন কথা । তাঁরা বলছেন কোম্পানিতে শেয়ারহোল্ডারগনের প্রত্যক্ষভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি পরিচালনা পর্ষদ থাকা স্বত্তেও বাইরে থেকে ৫ জনকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ কতটা যৌক্তিক। এতে কোম্পানিরই পরিচালনা ব্যয় বাড়বে এবং চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে শেয়ারহোল্ডাররা। কোম্পানি কতৃপক্ষ বলছে, তারা কোম্পানির দায়িত্ব নিলে, মালিক পক্ষ কোম্পানিটির উৎপাদনে জড়িত থাকতে পারবে না। আর তখন ব্যাংক টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিবে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায় , স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়া শেখ মামুন খালেদের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া নিয়োগ পেয়েছেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আবিদ আল হাসান। কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের রাজনৈতিক পরিচয়ধারীদের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে নিয়ে তাই সংশয় তৈরি হয়েছে।
কোম্পানি সুত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে এছাড়া মন্দা পরিস্থিতিতে যখন দেশের বেশীরভাগ কোম্পানী বোনাস নগদ পরিশোধ না করে শেয়ার ধরিয়ে দিতে চায়, তখন সিমটেক্স প্রতিবছর নগদ লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। দেশের এই মন্দার মধ্যে এতো ভালো অবস্থায় থাকা স্বত্তেও সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজে কোম্পানিতে নতুন পরিচালক নিয়োগ ভালো ভাবে দেখছেন না কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। কোম্পানি সচিব আশীস কুমার সাহার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় দ্য রিপোর্টে পক্ষ থেকে। তিনি বিএসইসির সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।এ ব্যাপারে কথা বলতে সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুর রহমানের সাথে তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেস্টা করে হলে তাকে পাওয়া যায়নি।নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কোম্পানির এজিএমে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের সরাতে বিএসইসিকে প্রভাবিত করা হয়েছে। এখন যাদের দেওয়া হয়েছে- তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এতে কোম্পানি ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতি হবে।
সিমটেক্সের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে দ্য রিপোর্ট কথা বলে বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইত উল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন "আগের পরিচালনা পরিষদ গঠনের বিষয়ে বিএসইসিতে অবহিত করা হয়নি। তাছাড়া পরিচালনা পরিষদ ভেঙ্গে দেওয়ার এখতিয়ার বিএসইসির রয়েছে"।
বি ক্যাটাগরির এই কোম্পানিটি ২০১৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। বর্তমান শেয়ার সংখ্যা ৭ কোটি ৯৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮১টি। কোম্পানির পরিচালকদের কাছে ৩১ দশমিক ৬৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার আছে ১৫ দশমিক ০৫ শতাংশ এছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। কোম্পানিটির বর্তমান মূলধন ৭৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। আজ কোম্পানিটির ক্লোজিং দর ছিল ১৪ টাকা ২০ পয়সা। উল্লেখ্য, কোম্পানি ২০২১ ও ২০২২ সালে বিনিয়োগকারীদের ৪ ও ৮ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ২০২২ সমাপ্ত সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ২১ পয়সা। এছাড়া, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) ছিল ২২ টাকা ০৪ পয়সা।
(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/ মাহা/৩০ মার্চ,২০২৩)