বাড়তি দামে ঈদ মাটি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের
মাহি হাসান, দ্য রিপোর্ট: রমজান ও ঈদ উপলক্ষ্যে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া দেশের ব্যবসায়ীদের পুরোনো অভ্যাস। ঈদ উপলক্ষ্যে বাজারে সেমাই,চিনির ব্যাপক চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি সেমাই তৈরিতে প্রয়োজনীয় সামগ্রী দুধের দাম বেড়েছে বছরজুড়েই। একই সঙ্গে ফিরনি, পোলাও রান্নার সব ধরনের সুগন্ধি চালের দামও সারা বছর বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ ও বাজারের তথ্য বলছে, গত বছরের তুলনায় এসব পণ্যের দাম এবার বেশি গুনতে হবে ২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত।
যদিও রমজান মাসের পুরোটা সময়জুড়েই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে অসন্তোষ ছিল ক্রেতাদের মধ্যে। মাছ-মাংস-সবজি কিনতে হিমশিম খেতে হয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। এখন ক্রেতাদের আবার ঈদের বাজার করতে গিয়ে দিশেহারা অবস্থার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। কারন ঈদের আগে আরেক দফা বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম। রাজধানীর অন্যতম পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজার সহ একাধিক খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে ঈদ উপলক্ষ্যে প্রতিটি পণ্যের দামে আগুন লেগেছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্যের বাড়তি দাম থাকায় চাহিদা কমে গেছে। বাজারে সৃষ্টি হয়েছে ক্রেতা সংকট। দ্য রিপোর্ট ঈদের বাজারের পণ্যসহ পর্যবেক্ষন করেছে অন্যান্য পণ্য নিয়েও।
সেমাই :
রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত বছর ২০০ গ্রাম ওজনের বিভিন্ন কোম্পানির সেমাইয়ের প্যাকেটের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে। যা এবছর ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা দোষ দিচ্ছেন কোম্পানির। তাঁরা বলছেন কোম্পানি থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে তাই বাড়্রতি দাম। উল্টো দিকে কোম্পানি বলছে সব কিছুর বাড়তি থাকায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের থেকে দাম বেড়েছে সব পণ্যের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বনফুলের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, “এবার কাঁচামালের দাম অনেক বেশি। সেমাই তৈরির জন্য ব্যবহৃত ময়দা, তেলসহ অন্য উপকরণের দাম বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে সেমাইয়ের দামে”। বছরব্যাপী বিক্রি হওয়া মাঝারি মানের বনফুলের ২০০ গ্রামের লাচ্ছা সেমাই বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা প্যাকেট। যা এক মাস আগেও বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকা প্যাকেট। মাসখানেকের মধ্যে পাইকারি দামই বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকার বেশি। একই সেমাই অনলাইন শপে ২০০ গ্রামের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় দোকানগুলোতে ৫ টাকা আর অনলাইন শপে বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা বেশি দামে। সে হিসেবে কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৫০ টাকা বেশি। মিঠাইয়ের বাদাম কিশমিশ ও ঘি সমৃদ্ধ লাচ্ছা সেমাই ২০০ গ্রামের প্যাকেট ১৫০ টাকা। অথচ এক বছরে আগে ২৫০ গ্রাম সেমাই বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকায়। অর্থাৎ, আগের বছরের তুলনায় মিঠাই ব্র্যান্ডেড সেমাইয়ের পরিমাণও কমেছে দামও প্যাকেট প্রতি বেড়েছে ৫০ টাকা। মালিবাগ বাজারে সেমাই কিনতে আসা গৃহিনী পারভিন সুলতানা বলেন, “গত বছর থেকে বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। ঈদের দিন সকালে সেমাই তো খেতেই হবে কিছু করার নেই”।
চিনি
এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সামগ্রি চিনি। বছরের ব্যবধানে এবার প্রতি কেজি চিনির জন্য গুনতে হবে ৩৭ থেকে ৫০ টাকা বেশি। চিনির দামের বিষয়ে খোঁজ নিতে রাজধানীর রামপুরা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১৩০ টাকায়। আর প্যাকেটজাত চিনি ব্র্যান্ডভেদে ১২০-১৪০ টাকা এবং দেশি মিলগুলোর আখের চিনি ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে। চিনির দাম নিয়ে সারা বছরজুড়েই নানা আলোচনা ছিলো। বাজারে চিনি নেই এমন অনেক অভিযোগও শোনা গিয়েছে। তবে বর্তমানে ব্যবসায়ীরা বলছেন চিনি এখনো পর্যাপ্ত সাপ্লাই আছে। কারওয়ান বাজারের বিসমিল্লাহ স্টোরের মালিক আব্দুর রহিম মোল্লা বলেন, রোজার সময় যে দামে চিনি বিক্রি হয়েছে এখন সে দামেই হচ্ছে। রোজার আগে দাম বেড়েছিলো। এখন ঈদের আগে দাম বাড়েনি। বাড়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, বাজারে চাহিদা এখন অনেক কম । গত বছরের তুলনায় সবকিছুর বেচা-বিক্রি কম বলে জানান এই বিক্রেতা। শুধু চিনি নয় সব পণ্যের চাহিদা অনেক কম।
দুধ:
গেলো বছরে প্রতিদিনই বেড়েছে দুধের দাম। বাড়তে এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে দুধের দাম । গত এক মাসে দফায় দফায় দাম বাড়িয়েছে গুঁড়ো দুধের শীর্ষ বিপণনকারী কয়েকটি কোম্পানি। আন্তর্জাতিক বাজারে গুঁড়াদুধের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় বাজারেও পণ্যটির দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। খুচরা বিক্রেতারা জানান, বিদেশি ব্র্যান্ডের এক কেজি গুঁড়া দুধের দাম দাঁড়িয়েছে ৮২০ থেকে ৮৫০ টাকা। আর দেশি ব্র্যান্ডের গুঁড়া দুধ বিক্রি হচ্ছে ৭৮০ থেকে ৮২০ টাকার আশপাশে।
এছাড়া, রোজার আগেই বেড়েছে প্রায় সব ধরনের মসলা, বাদাম ও কিশমিশের দাম। বেড়েছে পোলাও-বিরিয়ানির জন্য ব্যবহৃত সুগন্ধি চালের দাম । সুগন্ধি চাল গত এক বছরে কেজিতে বেড়েছে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা পর্যন্ত। গত বছর ঈদে যে চালের কেজি ১১০-১১৫ টাকা ছিল, তা কিনতে গুনতে হবে ১৬০-১৭০ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন,তাদের এখন এই চাল কিনতেই হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা কেজিতে। পরিবহন খরচ সহ তাদের এর চেয়ে কম দামে বিক্রি করলে থাকবে না কিছুই। এছাড়া এছাড়া মাঝারি মানের কিশমিশ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা কেজিতে। আর কাজু বাদাম বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজিতে। সুপার শপগুলোতে ১০০ গ্রামের কিশমিশ বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা। ২৫ গ্রামের পেস্তাবাদাম বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা। ৫০ গ্রামের কাজুবাদাম বিক্রি হচ্ছে ৭৮ টাকা।
রামপুরার সবজি বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত ১৫ দিনের ব্যবধানে বেশিরভাগ সবজির দাম কেজিতে ৫ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। টমেটো ৪০-৬০ টাকা, বরবটি ৭০ টাকা, ঢেঁড়স ৫০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, ঝিঙ্গা ৭০ টাকা, পটল ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে । কাকরোল ১০০ টাকা, পেঁপে ৬০ টাকা, লতি ৬০-৭০ টাকা, গাজর ৮০-১৪০ টাকা, ধুন্দুল ৮০ টাকা, শসা ৯০ টাকা, , শিম ৬০ টাকা, বেগুন মানভেদে ৬০-৬৫ টাকা, কুমড়া ৩০ টাকা, মরিচ ৬০ টাকা। এদিকে তীব্র গরমের কারণে চাহিদা বেড়েছে লেবুর। তাই পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দাম। এখন মানভেদে হালি ৪০ থেকে ১২০ টাকায় ও বিক্রি হচ্ছে। দাম বেড়েছে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলুর। দুই সপ্তাহ আগে ২০ টাকা কেজির আলু বিক্রি হচ্ছে ৩৬টাকায়। আলুর দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিক্রেতারা বলছেন, আলু স্টোরেজ থেকে না ছাড়ার কারণে বাজারে সরবরাহের ঘটতি রয়েছে। তাই দাম বেশি। দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৬-৪০ টাকা, ৯০ টাকার দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা ১৪০ টাকার মিয়ানমারের আদা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা।
ঈদের সময় মসলার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে এই পণ্যটিরও। দুই সপ্তাহ আগেও ২২০০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া এলাচ এখন ২৫০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ৩৮০ টাকার দারুচিনি বিক্রি হচ্ছে ৪৪০ টাকা, ৩০০ টাকার শুকনা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা, ৬০০ টাকার জিরা বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা, ২০০ টাকার ধনিয়া বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজি কালোজিরা বক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা, লবঙ্গ ১০০০ টাকা, গোল মরিচ ৯০ টাকা, জয়ফল ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা, জয়িত্রী ৩৫০০ টাকা। অন্যদিকে ফের বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম। আজ বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকায়। এছাড়া ৩৫০ টাকার সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩৭০ টাকা। দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিটি মাছের দাম ২০-৩০ টাকা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। মাছের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে মো. নাহিদ নামের কারওয়ানবাজারের মাছ বিক্রেতা বলেন, ঈদের আগে পণ্যবহী গাড়ি বন্ধ থাকায় চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নেই। তাই দামও বেশি। তবে অপরিবর্তিত আছে সাধারন চালের বাজার। এখন প্রতি কেজি মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৭২ টাকা, নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা, পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকা, স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৪৬ টাকা, আটাশ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকা। ঈদের পর আটাশ ও মিনিকেটের দাম কমবে বলে আশা করছেন বিক্রেতারা। আগের মতোই আছে গরু ৭৫০ টাকা কেজি ও খাসি ১১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ঈ
এ ব্যাপারে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, "গত বছরের তুলনায় এবার সব ধরণের পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা প্রতি বছর বাড়ছে। প্রতি ঈদেই বলি এবারো বলেছি আগামীবার ও বলবো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম তদারকি প্রয়োজন। যদিও অন্যবারের তুলনায় বাড়তি দামের বিরুদ্ধে এবার মাঠ পর্যায়ে অভিযান চালানোর ফলাফল পেয়েছি কিছুটা, এটা অব্যাহত থাকতে হবে বছরজুড়ে"।
(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/ মাহা/২০ এপ্রিল,২০২৩