ভুল নীতির খেসারত দিচ্ছে পুঁজিবাজার
মাহি হাসান, দ্য রিপোর্ট : একযুগ ধরে ভুল নীতির খেসারত দিচ্ছে পুঁজিবাজার। ভুল নীতি, বিচারহীনতা, আইন প্রয়োগে বৈষম্য, মার্জিন ঋণের সুদে স্থবির হয়ে গেছে পুঁজিবাজার। একশ্রেণির কারসাজি চক্র শেয়ার বাজার ব্যবহার করে গড়ে তুলছে অর্থের পাহাড়। নিঃস্ব হচ্ছেন প্রকৃত বিনিয়োগকারী।
১৯৯৬ এর আলোচিত শেয়ার ধসের পর ২০১০ সালে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তদন্ত ,অনুসন্ধান, সংস্কার, নতুন আইন তৈরিতে পেরিয়ে গেছে আরও ১২ বছর। কিন্তু থামেনি বাজারের অস্থিরতা। মন্দা শেয়ারবাজারেও নিত্যদিন নতুন নতুন কৌশল নিয়ে হাজির হচ্ছে নানা ধরনের কারসাজি চক্র। নতুন নতুন আইটেম তুলে দিচ্ছে দিশেহারা বিনিয়োগকারীদের হাতে। পুঁজিবাজার সংক্রান্ত বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে করা হচ্ছে এসব অপপ্রচার। সরল মনের অনেক বিনিয়োগকারী লাভের আশায় হচ্ছেন প্রতারিত। হচ্ছেন পুঁজিহারা।
গুজব, ইনসাইডার ট্রেডিং,টাকার বিনিময়ে ট্রেডিং গ্রুপের সদস্য বানিয়ে সংঘবদ্ধ কারসাজি চলছেই। আইপিও অনুমোদনে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির বেড়াজালে আটকে গেছে শেয়ারবাজার। মার্জিন ঋণ আর ফ্লোর প্রাইসে থেমে গেছে বাজারের গতি। সূচক আর লেনদেন চলে এসেছে প্রায় ১২ বছর আগের অবস্থানে। এই বাজারের চলমান কারসাজি নিয়ে উদ্বিগ্ন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
১৯৯৬ সালের ধস কাটিয়ে প্রায় ১০ বছর পর ২০০৬ সালের দিকে স্বাভাবিক হতে শুরু করে বাজার। ওই সময় দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ২৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকার ক্ষমতায় আসার এক সপ্তাহের মাথায় ১৮ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো ডিএসইতে লেনদেন হয় ১০০ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে গড় লেনদেন হয় ১৩৬ কোটি টাকা। তবে অস্বাভাবিক উত্থানের শুরু হয় ২০০৯ সালের গোড়ার দিকে, যখন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসেন। তখন বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ আর মার্চেন্ট ব্যাংক থেকে সংঘবদ্ধ ভাবে শেয়ার কিনে দর বাড়াতে থাকে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র। ব্যাংকগুলো আগ্রাসী বিনিয়োগ শুরু করে। শুরু হওয়া ওই উত্থানের দুই বছরের মাথায় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে চূড়ায় ওঠে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)এর প্রধান মূল্যসূচক। এরপর শুরু হয় ধস। উত্থানের পর পতন এই নিয়ম মেনে তলানীতে পৌঁছে যায় শেয়ারবাজার। পুঁজি হারিয়ে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে পড়েন। আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ডিএসই সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ২ হাজার ৭৫৭ পয়েন্ট। ওই বছরের শেষদিকে ৩০ ডিসেম্বর ডিএসই’র সাধারণ মূল্যসূচক দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার পয়েন্টে। ২৪ মাসের মাথায় ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর মূল্যসূচক ৩০০ শতাংশ বা ৫ হাজার ৫৩৩ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে দাড়িয়েছিল ৮ হাজার ৯১৯ পয়েন্টে। ওই দিন লেনদেন হয় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার ওপরে। অস্বাভাবিক এই দরবৃদ্ধির পরই শুরু হয় পতন। চলে টানা কয়েক বছর। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে এসে সূচক কমে দাঁড়ায় ৪০ শতাংশ বা ৩ হাজার ৬৯৯ পয়েন্ট ।
১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৮০০-এর ঘরে। ১০ মাসের ব্যবধানে ৫ নভেম্বর তা ৩ হাজার ৬৪৮ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। এরপর বাজারে ধস শুরু হলে ডিসেম্বরে সূচক ২ হাজার ৩০০ পয়েন্টের নিচে নেমে যায়। এক বছরের ব্যবধানে ১৯৯৭ সালের শেষ সপ্তাহে সূচক নেমে আসে ৭৫০ পয়েন্টের ঘরে। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ৫৪০ পয়েন্টে এবং ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে ৫০০ পয়েন্টের নিচে নেমে যায় সূচক। বর্তমানে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার লেনদেন হলেও ওই সময় কাগজের শেয়ারে লেনদেন হতো। কারসাজি চক্রের হোতারা শেয়ারের জাল সার্টিফিকেট বানিয়ে বাজারে চড়া দামে বিক্রি শুরু করে।
নতুন সূচক চালু
২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ৪ হাজার ৫৫ দশমিক ৯০ পয়েন্ট দিয়ে ডিএসইএক্স সূচক চালু হয়। এর আগে ডিজিএন সূচক চালু ছিলো। চার মাস ধরে দুটি সূচক চালু থাকার পর ৩১ জুলাই ডিজিএন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই বছর ৩০ এপ্রিল ডিএসইএক্স সুচক ৩ হাজার ৪৩৮ পয়েন্টে নামে। ডিএসইএক্স কমতে কমতে এক পর্যায়ে নেমে আসে ২০০৯ সালের অবস্থানে।
২০১৩ সালেরও পরও পতন আর উত্থানের ধারা অব্যহত থাকে। ফ্লোর প্রাইস বা শেয়ারের নিম্ন মূল্যস্তর দেওয়া হয়েছিলো ২০২০ সালের ১৯ মার্চ। এরপর করোনার কারণে ৬৬ কার্যদিবস বন্ধ ছিলো বাজার। খোলার পরপরই সূচক প্রায় ৩ হাজার পয়েন্টে নামে।
এই বারো বছরে ১৩০ টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে ডিএসইতে। তাতে বাজারের আকার বড় হয়েছে। নতুন মূলধন যোগ হয়েছে । কিন্তু নতুন কোম্পানির অধিকাংশ শেয়ারের দর ইস্যু মূল্যের নিচে নেমেছে। আজ (২২মে ,২০২৩)ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্সআগের দিনের চেয়ে দশমিক ৩৫ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ৬ হাজার ২৮১ পয়েন্টে।সূচকের বিচারে বাজার ফিরে গেছে আগের অবস্থানে যাকে স্বাভাবিক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে কারসাজি চলছে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে। এর সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কেউ কেউ জড়িত বলে বাজারসংশ্লিষ্টদের সন্দেহ। এই সন্দেহ সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও। এর কিছু নমুনাও রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনৈতিক সংযুক্তি বাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীন করে তুলেছে। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে অর্থমন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতা বাজারকে আরো ক্ষতি করেছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কারসাজি চক্রের সঙ্গে মিলে মিশে লেনদেন করছে। তাতে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা লাভবান হয়েছেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় প্রতি ৬ মাস পর পর বাজার কিছুদিন চাঙ্গা হয়। এসময় সূচকের ব্যাপক উত্থান ঘটে। কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধি পায় কিছু দিন। এরপর আবার পতনের ধারায় ফিরে যায়।
কারসাজি চক্র কয়েকটি কোম্পানিকে টার্গেট করে দর বৃদ্ধি ঘটায়। তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হয়ে পতঙ্গের মতো ছুটে আসেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে অতিমূল্যায়িত শেয়ার বিক্রি করে কারসাজি চক্র বেরিয়ে যায়।
২০১০-১১ সালের মহামন্দার পর বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ভেঙ্গে নতুন কমিশন গঠন করা হয়। অধ্যাপক খায়রুল হোসেনকে চেয়ারম্যান করে নতুন কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন ২০১১ সালের মে মাস থেকে ২০২০ সালের মে মাস পর্যন্ত টানা নয় বছর দায়িত্ব পালন করে। এসময় প্রায় ১০১টি আইন তৈরি ও সংস্কারের উদ্যেগ নেওয়া হয়। এরমধ্যে ৯৫ টি আইন সংস্কার করা হয় অধ্যাপক খায়রুল হোসেনের মেয়াদে। খায়রুল হোসেনের মেয়াদ দুইবার বাড়ানো হয়েছিলো। তার দায়িত্বপালন শেষ হলে ২০২০ সালের ১৭ মে অধ্যাপক শিবলী রুবাইত উল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে নতুন কমিশন গঠন করা হয়। নতুন কমিশনের হাতে আগের অসমাপ্ত ৬টি আইনী সংস্কার হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনার কাঠামো বদলে ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছে। সূচক নির্ধারণ পদ্ধতির পরিবর্তন করা হয়েছে। এরমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।এসইসি (সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন)এর নাম বদলে বিএসইসি (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন)করা হয়েছে। বি ক্যাটাগরির কমিশন এ ক্যাটাগরিতে উন্নীত হয়েছে। বিএসইসির চেয়ারম্যান আন্তজার্তিক সংস্থাআইএসকোর সহ-সভাপতি নির্বচিত হয়েছেন।
কিন্তু বাজার তার গতিপথ খুঁজে পায়নি। বরং একাধিক কারসাজি চক্রের হাতে ঘুরপাক খাচ্ছে শেয়ারবাজার।এছাড়া মার্জিন ঋণের কারণে বাজার আটকে রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। দরপতন ঠেকাতে বাজারে নিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে আরো স্থবির হয়ে পড়েছে বাজার।
কেন এমন হলো?
এ প্রশ্নে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব আইন করা হয়েছে তার বেশ কয়েকটি আইনে গলদ রয়েছে। আবার আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় এসব আইন প্রয়োগ করা যায়নি। বরং উল্টো ফল বয়ে এনেছে। আবার অন্য দেশের আইন অনুসরণ করে আইন করতে গিয়ে বিপরীত মুখী আইন হয়েছে। যার প্রয়োগ করায় হিতে বিপরীত হয়ে তা বাজারে নেতিবাচক প্রভাবই পড়েছে। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থায় অসৎ ব্যক্তিদের প্রভাব বেড়েছে। মিডিয়ায় তাদের নিয়ে নেতিবাচক খবর প্রকাশ হওয়া এবং প্রকাশিত খবরের বিরুদ্ধে তেমন প্রতিবাদ না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর আস্থা হারিয়েছেন।
যেসব নতুন আইন হয়েছে
ডিমিউচুলাইজেশন আইন করা হয়েছে। এই আইনের আওতায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকদের হাত থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদা করা হয়। তালিকাভুক্তি আইন সংস্কার করা হয়েছে। এর ফলে সরাসরি তালিকাভুক্তির সুযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি বুক বিল্ডিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। কোম্পানির শেয়ার ধারণ সংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর আওতায় পরিচালকদের ২ শতাংশ ও কোম্পানির ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।
আইনের নেতিবাচক প্রভাব
ডি-মিউচুলাইজেশন আইনের প্রয়োগে এখন ডিএসইর বোর্ড মেম্বারদের ক্ষমতা খর্ব করে বিএসইসির কর্মকর্তাদের হাতে নেওয়া হয়েছে। ফলে আরো বেশি আমলা নির্ভর ও কেন্দ্রীভূত হয়েছে ক্ষমতা। বোর্ড স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারছে না বলে অনেক বোর্ড মেম্বার অভিযোগ করে থাকেন। বোর্ড মেম্বার বা পরিচালক নিয়োগে বিএসইসির সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। এছাড়া ট্রেক হোল্ডোররা ডিএসইরও শেয়ারহোল্ডার। ফলে মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে সে প্রশ্ন রয়েই গেছে।
পরিচালকদের শেয়ার ধারণের ২ শতাংশের বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ এখনো সব কোম্পানির পরিচালকদের ২ শতাংশ শেয়ার ধারণে বাধ্য করা যায় নি। যদি কোনো কোম্পানির ৫ জন পরিচালক থাকেন এবং প্রত্যেকে ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেন তবে সর্বোচ্চ শেয়ার ধারণের সীমা ১০ শতাংশ হওয়া ছিলো যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে। কোম্পানিগুলো ওই ৩০ শতাংশের কোনো দায় বহন করছে না। বর্তমানে তিরিশ শতাংশ শেয়ারধারী পরিচালকরা ক্যাশ ডিভিডেন্ড বা নগদ লভ্যাংশের মুনাফা তুলে নিতে পারেন। কিন্তু স্টক বা বোনাস শেয়ারের লভ্যাংশ নিজেরা নিতে পারেন না। তাতে পরিচালকদের উৎসাহে ভাটা পড়ে। আবার স্টক ডিভিডেন্ড না দেওয়ার জন্যও বিএসইসির পক্ষ থেকে একধরনের চাপ রয়েছে কোম্পানিগুলোর ওপর।
বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে লিস্টিং বা তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে যেকোনো কোম্পানির শেয়ারদর নির্ধারণ করার জন্য নিলাম ডাকার নিয়ম। সেক্ষেত্রে ডাচ পদ্ধতিতে সর্বনিম্ন দরের শেয়ারকে আসল মূল্য ধরে বাজার দর নির্ধারণ করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এক্ষেত্রে দর নির্ধারণ করে দিচ্ছে। ফলে ভালো প্রিমিয়াম বা শেয়ার মূল্য না পাওয়ার যে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে তাতে কোম্পানিগুলো বাজারে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে
ফ্লোর প্রাইস বা শেয়ারের নিম্ন মূল্যস্তর দেওয়া হয়েছিলো ২০২০ সালের ১৯ মার্চ । এর পর করোনার কারণে ৬৬ কার্যদিবস বন্ধ ছিলো বাজার। ইতোমধ্যে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দিয়ে বাজারকে স্বাভাবিক করার উদ্যেগ নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাজার আবার টালমাটাল হয়ে পড়লে গত বছর ৩১ জুলাই আবার ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হয়। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন যেসব শেয়ার কারসাজি চক্রের হাতে রয়েছে সেসব কোম্পানিকে ফ্লোর প্রাইসের বাইরে রাখা হচ্ছে। ওটিসি মার্কেট থেকে কোম্পানিগুলোকে এসএমই মার্কেটে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তাতে করে ভালো কোম্পানির শেয়ার আসছে না। বরং দুর্বল কোম্পানির শেয়ার এসে বাজারের শক্তি খর্ব করছে।
কেন ঘুরে দাড়াতে পারছে না
আস্থা সংকট :বাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করার একটা নিয়ম চালু করা হয়েছিলো। যেমন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বিষয়ে জাতীয় রাজস্ববোর্ড,বাংলাদেশ ব্যাংক,অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিএসইসি সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। ২০১১ সালের ৮ আগস্ট এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। প্রতি দুই মাস অন্তর এই চারটি সংস্থার নির্ধারিত কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিলো। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো মিটিং এর খবর কোনো গণমাধ্যমের কাছে পৌঁছেনি।
মহাধসের পর প্রায় ১৩০টি কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেনের পর এসব কোম্পানির শেয়ারের দর ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এসব কোম্পানির প্রাথমিক গণ প্রস্তাব বা আইপিও অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে অনৈতিক লেনদেন হয়েছে। দুর্বল মৌলভিত্তির কয়েকটি কোম্পানির কাছ থেকে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। বিএসইসির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন বলে যে অভিযোগ রয়েছে তা অনেকে প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস করে। ওটিসি মার্কেট থেকে এসএমই খাতে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশিত হওয়ায় ও তার কোনো প্রতিবাদ প্রকাশিত না হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মনে বিএসইসির প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তাছাড়া তালিকাভু্ক্তির কিছুদিন পর থেকেই অনেক কোম্পানির শেয়ারের দর পতন ঘটে ইস্যু মূল্যের নিচে নেমে গেছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে তা থেকে বাজার বের হতে পারছে না।
মার্জিন ঋণ :মার্জিন ঋণে আটকে গেছে বাজার। সেই ২০১০ সালের পর থেকে সেকেন্ডারি বাজারের মূলধনের বড় একটা অংশ মার্জিন ঋণে আটকে রয়েছে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পযন্ত পাওয়া হিসেব থেকে জানাগেছে ১৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগকাীদের কাছে পাওনা রয়েছে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর। যার প্রভাব পড়েছে লেনদেনে। সর্বশেষ বিএসইসির কাছে মার্জিন ঋণের পরিমাণ জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন কোনো হাল নাগাদ তথ্য দিতে পারেনি। বিএসইসির এস আর আই বিভাগের কাছে তথ্য চাইলে এ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম জানান, এ ধরনের কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
আইন প্রয়োগে বৈষম্যের অভিযোগ
বাজারে কারসাজির দায়ে কয়েকজন ব্যক্তি বিনিয়োগকারীকে জরিমানা করা হয়েছে। এদের কারসাজির তুলনায় জরিমানার পরিমাণ অনেক কম। গত সেপ্টেম্বর মাসে আবুল খায়ের হিরু ও সহযোগী কয়েকজন আলোচিত বিনিয়োগকারীকে কারসাজির দায়ে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয় । সাতটি কোম্পানির শেয়ার কারসাজির দায়ে তাদের এই জরিমানা করা হয়। যা কারসাজির মাধ্যমে তাদের অর্জিত মুনাফার ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ কারসাজির মাধ্যমে তার আয় হয়েছিলো ২৩০ কোটি টাকা। এই হিরুকেই আবার জুন মাসে দুই কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। অন্যদিকে কম অপরাধে বেশি সাজা দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। গত নভেম্বর মাসে ব্যাংকো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পাঁচ বছরের জন্য শেয়ারবাজারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জরিমানা করা হয় ২৬ কোটি টাকা। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন প্লেসমেন্ট শেয়ার ক্রয়সংক্রান্ত একটি আইনী জটিলতা নিয়ে এই জরিমানা করা হয়েছে যেখানে আইনের সঠিক প্রয়োগ হয়নি। বিচারের নামে হয়েছে পক্ষপাত দুষ্টতা।
বিচারহীনতা
২০১০ সালের ধসের পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশে ২০১৪ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এ পর্যন্ত এই ট্রাইবুনালে ২৬টি মামলা স্থানান্তরিত হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। দুটি মামলা খারিজ হয়েছে। দুটি মামলা ফেরত গেছে। ১০টি মামলা হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত হয়েছে।
স্থগিত বা খারিজ হওয়া মামলাগুলোর আসামিরা ব্যাংক ও আর্থিক খাতে অত্যন্ত প্রভাবশালী। এদের মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যানপ্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও রয়েছেন। আরো আছেন এইচ আর সি গ্রুপের চেয়ারম্যান সাঈদ হোসেন চৌধুরী, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা বোর্ডের সাবেক সদস্য শাহদুল হক বুলবুল। নাম ছিল আরো দুজনের। এরা হলেন র্যাংগস গ্রুপের চেয়ারম্যান এ রউফ চৌধুরী ও ডিএসইর সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান। দুজনই মারা গেছেন।
রাজধানীর পল্টনে হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের দশম তলায় অবস্থিত এইট্রাইবুনালে একজন জেলা ও দায়রা জজ বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই আদালতে নতুন করে একটি মাত্র মামলার কার্যক্রম চলছে। নতুন এই মামলার বিবাদী সুহৃদ ইন্ড্রাট্রিজ লিমিটেড। বিএসইসি এই মামলার বাদি। মামলা নং মার্চ ০১/২০২৩।
বিএসইসির ২০০৯ সালের মে থেকে ২০১১ সাল মে মাস পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী বিএসইসি সাবেক চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার দ্য রিপোর্টকে বলেন বিএসইসি তো বেশকিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। পৃথিবীর সব দেশেই কারসাজি হয়ে থাকে। তবে বিনিয়োগকারীদের নিজেদের স্বার্থ নিজেদেরই দেখতে হয়। মনে রাখতে হবে লাভের টাকা হারানো আর মূল টাকা হারানো এক কথা নয়। একবার টাকা লোকসান হলে তা আর ফিরে আসে না। যদি এফডিআর বা সঞ্চয় পত্রে লংটার্ম বিনিয়োগ করতে পারেন তবে শেয়ারবাজারে কেন করবেন না। ভালো কোম্পানির শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করলে তাতে ঝুঁকি কম, মুনাফা হবেই।
২০১১ মে থেকে ২০২০ সালের মে মাস পযন্ত দায়িত্বপালনকারী বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন বাজার পরিস্থিতি বা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন তার আমলে গৃহীত ১০১টি পদক্ষেপ ও আইন সংস্কারের উদ্যেগ নেওয়ার হয়। যার প্রভাব রয়েছে বাজারে।
বাজার ধসের আগে দায়িত্ব পালনকারী বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ১২ বছরে যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্তে হয়েছে তার বেশিরভাগ কোম্পানিই দুর্বল মৌলভিত্তির। বাজারে দুর্বল কোম্পানি আসলে তার কুফল ভোগ করতে হবে সেকেন্ডারি মার্কেটকে। তিনি বলেন, ১২ বছরে যেসব সিদ্ধান্ত বা আইন হয়েছে তার কোনোটা বাস্তবায়ন হয়নি। আবার কোনোটা ফল হয়েছে উল্টো। যেমন ডি মিউচুলাইজেশনের যে মুল ধারণা তার কোনো বাস্তবায়নই হয়নি। যারা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার হোল্ডার তারাই আবার ব্রোকারেজ হাউজের ট্রেক হোল্ডার বা মালিক। তাতে মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদা করা যায় নি।
এছাড়া ফ্লোর প্রাইস দিয়ে মার্কেটকে মেরে ফেলা হয়েছে। ফ্লোর প্রাইসের কারণে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। কোনো বিনিয়োগকারী ইচ্ছা করলেই শেয়ার বিক্রি করে বেরুতে পারছেন। তাকে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করতে হচ্ছে। বিদেশী বিনিয়োগকারী আসছে না। মাত্র ৬০ /৭০ টা কোম্পানির শেয়ার কেনা বেচা হচ্ছে। তিনি বলেন ফ্লোর প্রাইস না উঠালে শেয়ারবাজার ভালো হবে না।
মার্জিন ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মার্জিন ঋণ নিয়ে ভালো শেয়ার কিনবেন কিভাবে। ধরা যাক, কেউ গ্রামীণ ফোনের শেয়ার কিনলেন। যে পরিমাণ লভ্যাংশ পাবে তার চেয়ে তাকে বেশির সুদের টাকা শোধ করতে হবে । তাতে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হবে। দুই শতাংশ শেয়ার ধারণ সংক্রান্ত আইনের ও কোনো সুফল বাজারে পড়েনি বলে মন্তব্য করেন বিএসইসির সাবেক এই চেয়ারম্যান।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ডি মিউচ্যুলাইজেশন বা কোম্পানির ২ বা ৩০ শতাংশ শেয়ারধারণ সংক্রান্ত আইনের কোনো প্রভাব বাজারে নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। ফ্লোর প্রাইস আরোপের সমালোচনা করে তিনি বলেন, সব কোম্পানির ওপর ফ্লোর প্রাইস না থাকলে বাজার স্বাভাবিক হবে। নিজস্ব গতিতে চলবে। তিনি বলেন বর্তমানের মার্জিন ঋণ নিয়ে বাজারের গতি ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছে , যেটা বাজারের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। মার্জিন ঋণ মানেই কৃত্রিম উপায়ে শেয়ারের দর বৃদ্ধির প্রচেষ্টা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী বলেন, ব্রোকারেজ হাউজগুলো ২০০৯ সালের পতনে অনেক বিনিয়োগকারি মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে পুঁজিবাজারে। পুঁজিবাজারে ধস নামলে অনেক বিনিয়োগকারি ক্ষতির মুখে পড়ে। মার্জিন ঋণ নিয়ে ক্ষতির মুখে পড়লে সেই টাকা আর পায়নি ব্রোকারেজ হাউজগুলো। তখনকার ক্ষত এখনো তাদের টানতে হচ্ছে।
মতিঝিলে অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রথম সারির ব্রোকারেজ হাউজের এই সিইও বলেন, বর্তমান সময়ে লেনদেন কমে যাওয়ায় ব্রোকারেজ হাউজগুলোর যে করুণ অবস্থা হয়েছিল তা পোষাতে অনেকে কর্মী ছাটাই করতে বাধ্য হয়। পুঁজিবাজার ধসের সময় মার্জিন ঋণের কবলে পড়া ক্ষতি থেকে এখনো উঠতে পারে নি ব্রোকারেজ হাউজগুলো। যার কারণেএখনো তারল্য সংকটে আছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইত উল ইসলাম ২০২০ সালের মে মাস থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সামগ্রিক বিষয়ে দ্য রিপোর্টকে তিনি বলেন, কমিশন বাজারের আস্থা ফেরানোর সব ধরনের কাজ করে যাচ্ছে। কমিশনের পক্ষ কোনো ধরনের দুর্নীতির প্রশ্রয় দেয়া হয় না। তিনি বলেন বাজারে অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির পর পতন ঘটে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে যখন ডিএসইর সূচক সাত হাজার পয়েন্টে পৌঁছেছিলো তখনই কমিশন সতর্ক হয়ে ওঠে। তখন বাজার নিয়ন্ত্রণ না করলে আবার দশ সালের মতো পরিস্থিতি হতে পারতো। আমরা সতর্ক রয়েছি। তিনি বলেন ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হয়েছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে। যখন বুঝবো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ হয়েছে তখনই ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দিবো।
(সহযোগিতা করেছেন: মাহি হাসান)