নগদ: লোকসানি প্রতিষ্ঠানের বন্ড অনুমোদন কতটা যৌক্তিক?
মাহি হাসান, দ্য রিপোর্ট: বর্তমানে দেশের অন্যতম আলোচিত এক প্রতিষ্ঠান “নগদ”। মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (এমএফএস) নগদ সম্প্রতি প্রতিষ্ঠার পর থেকে সর্বশেষ আর্থিক বছর পর্যন্ত লোকসান দেখিয়েই গিয়েছে। লোকসানের পরিমাণ টাকার হিসেবে প্রায় ৬২৬ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করা নগদের ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬০০ কোটি টাকার বেশি।
ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই যেখানে হিমশিম অবস্থা সেখানে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড একচেঞ্জ কমিশন(বিএসইসি) লোকসানি এই প্রতিষ্ঠানটিকে গত সপ্তাহে অনুমতি দিয়েছে বন্ড ছেড়েপুঁজিবাজার থেকে৫১০ কোটি টাকা উত্তোলনের। উত্তোলিত এই ৫১০ কোটির প্রায় ৮০ শতাংশ নগদ ব্যয় করবে স্বল্পমেয়াদী ঋণ পরিশোধে। এমন বাস্তবতায় থাকা নগদের আগামী অর্থ বছরেও মুনাফায় যাওয়ার সুযোগ কম।
মোবাইল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদের প্রসপেক্টাসে বলা আছে, ২০২৫ সালের মধ্যে তারা লাভজনক কোম্পানিতে পরিণত হবে। এর আগে টানতে হবে লোকসানের বোঝা। প্রসপেক্টাসের বর্ণনা মতে আগামী বছর নগদের আয় বেড়ে ১১৪৪ কোটি হলেও লোকসানে থাকার ঝুকি রয়েছে । ২০২৫ সালে আয় হবে ১,৩২৪ কোটি। ২০২৫ সালে নিট মুনাফা হবে ২৮ কোটি টাকা বলে আশা করছে প্রতিষ্ঠানটি। হিসাব অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠার ৬ বছর পর মুনাফার মুখ দেখবে লোকসানি প্রতিষ্ঠান নগদ। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে নগদের আয় ধীরে ধীরে বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৭ কোটিতে। একইসাথে লোকসানও বেড়ে ২৬২ কোটি টাকা হয়। প্রসপেক্টাস থেকে আরো জানা গেছে, ব্যবসায়ের শুরুতে কোনো আয়ই করতে পারেনি। সর্বশেষ, গেলো (২০২১-২২) অর্থবছরে নগদের আয় ধীরে ধীরে বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৭ কোটিতে; সঙ্গে লোকসানও বেড়ে হয় ২৬২ কোটি টাকা। নগদের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতি আর্থিক বছরেই কোম্পানিটির মোট মুনাফার পরিমাণ বেশ ভালোই থাকে, কিন্তু পরিচালন, প্রশাসনিক, বিপণন ও প্রচারে অতিরিক্ত খরচের কারণে কোম্পানিটি মুনাফার দেখা পায়নি। কোম্পানির ২০২০-২১ আর্থিক প্রতিবেদন মতে, আলোচ্য বছর কোম্পানিটি বিপণন ও প্রচারের পেছনে খরচ করে ১২৪ কোটি। পাশাপাশি সর্বমোট প্রশাসনিক ব্যয় ছিলো ১৯০ কোটি টাকা। উল্টোদিকে সেসময় কোম্পানিটি মোট মুনাফা করেছিলো ৯০ কোটি টাকা। প্রশাসনিক ও বিজ্ঞাপন খরচ মেটানোর পরে নগদ ওই বছর লোকসান গুণে ১৮৭ কোটি টাকা । উচ্চ পরিচালন, প্রশাসনিক, বিপণন ও প্রচার খরচের কারনে ২০২১-২২ সালেও লোকসানের ধারা অব্যাহত রাখে নগদ। সেই বছর ১০১ কোটি টাকা মুনাফা করলেও পরিচালন ও প্রশাসনিক খরচ হয় ২৯২ কোটি টাকা। বছরশেষে, সব খরচ মিটিয়ে সার্বিকভাবে নগদের লোকসান দাঁড়ায় ২৬২ কোটি টাকা, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। যদিও প্রযুক্তি নির্ভর ও এমএফএস কোম্পানিগুলো সাধারণত প্রতিষ্ঠান শুরুর বছর থেকে কমপক্ষে ৪-৫ বছর লোকসানে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নগদ যখন ব্যবসায় শুরু করে তখন নগদের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগি ছিলো ব্র্যাক ব্যাংকের মালিনাধীন প্রতিষ্ঠান “বিকাশ”। যা এখনো রয়েছে। এখনও নগদকে পাল্লা দিয়ে ব্যবসায় করতে হচ্ছে বিকাশের সঙ্গেই। প্রতিষ্ঠার শুরুর পাঁচ বছর লোকসান গুণেছিলো বিকাশও । প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে ২০১০ সালে। কিন্তু ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত মুনাফা করতে পারেনি বিকাশ। ২০১৪ থেকে শুরু করে মুনাফা করা যা ২০১৮ পর্যন্ত চলমান থাকে। এরপরে ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ কোম্পানিটি এই তিন বছর মুনাফা করতে পারেনি। বিকাশের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় ,২০১৯ সাল থেকে কোম্পানিটি নতুন নানা ধরনের পরিষেবা বিনিয়োগ করে কেননা ২০১৮ সালে এমএফএস কোম্পানি হিসেবে মার্কেটে আসে নগদ। নগদের সাথে পাল্লা দিতে এই তিন বছর কোম্পানিটি খরচ বেড়ে যায় অনেক। যার ফলে মুনাফা করতে পারেনি ব্র্যাক ব্যাংকের মালিকানাধীন বিকাশ। যদিও সর্বশেষ ২০২২ সালে কোম্পানিটি আবারও মুনাফার ধারায় ফিরেছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকেও মুনাফার ধারা অব্যাহত রেখেছে বিকাশ। কিন্তু নগদের ক্ষেত্রে বাস্তবতা একটু ভিন্ন। বিকাশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান লোকসানে থাকলেও নগদের লোকসান ও ঋণের পরিমানে সবাইকে ছাড়িয়ে। এর মধ্যে আগাম জানান দিয়ে রেখেছে , ২০২৫ সালের আগে কোম্পনিটির মুনাফা করতে পারার সম্ভাবনা নেই। এমন বাস্তবতায়
কোন বিবেচনায় বন্ডের মাধ্যমে টাকা তোলার অনুমতি পেয়েছে? কিংবা বন্ড ছেড়ে টাকা তোলার অনুমতিত ব্যাপারে কি কি বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে এমন প্রশ্ন থাকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড কমিশনের কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদের কাছে । তিনি দ্য রিপোর্টে বলেন, " নিয়ন্ত্রক সংস্থা সকল ডকুমেন্ট, ব্যবসায়ের অবস্থা দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পুঁজিবাজারে মঙ্গল হবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে বিএসইসি। যথেষ্ট কারণ থাকায় এবং সকল বিধিবিধান পালন করেছে বলেই নগদকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে"।
এদিকে, নগদ সুত্রে পাওয়া খবরে জানা যায়, ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিয়েছিল নগদ। ২০২১-২২ অর্থবছরের আর্থিক বিবরণী অনুসারে, নগদের বর্তমানে ঋণের পরিমান ৬১৭ দশমিক ৬০ কোটি টাকা।বন্ডের উত্তোলিত অর্থ দিয়ে নগদ ৪০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করবে। ৫১০ কোটির বাকি ১১০ কোটি ব্যবহার হবে কার্যকরী মূলধন হিসেবে। টাকার এই বন্ডের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। এর বার্ষিক সুদহার হবে প্রায় ১০ শতাংশ। তবে নিয়মিত সুদ পরিশোধ করতে না পারলে ২ শতাংশ জরিমানা গুনতে হবে। বিএসইসিতে নগদের জমা দেওয়া প্রসপেক্টাস বা বিবরণপত্রে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। ৬১৭ কোটি ৬০ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এমন পরিস্থিতিতে ৫১০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর অনুমতি চেয়েছে নগদ যার থেকে ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করবে। বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত বাকি ১১০ কোটি টাকা খরচ করা হবে চলতি মূলধন খাতে। চলতি মূলধন খাতের টাকা খরচ হবে সেবা পরিচালনায় পর্যাপ্ত তারল্যের জোগান হিসেবে ও দৈনন্দিন খরচের জন্য। এ ব্যাপারে নগদের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান জাহিদুল ইসলাম বলেন, "পুঁজিবাজারে বন্ড ছেড়ে ৫১০ কোটি টাকা তোলার অনুমোদন পেয়েছি বিএসইসির কাছ থেকে। এই টাকা নগদের বিপণন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও ঋণ পরিশোধে খরচ করা হবে। যার মাধ্যমে নগদের সেবার মান আরও উন্নত হবে”।
লোকসানি প্রতিষ্ঠান নগদকে বন্ডের মাধ্যমে টাকা তোলা দেওয়ার অনুমতির বিষয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন,"পুঁজিবাজার ভালো করতে দরকার ভালো ইন্সট্রুমেন্ট। নগদ লোকসানি হলেও ব্যবসায়ে ভালো করবে এমন সম্ভাবনা করছে বলেই হয়তো অনুমতি দেওয়া হয়েছে"।
প্রসঙ্গত, মোবাইল ফাইনান্সিয়্যাল সার্ভিস হিসেবে নগদ যাত্রা শুরু করে ২০১৯ সালে । বাংলাদেশ পোস্ট অফিসের সঙ্গে পরিষেবা চুক্তির মাধ্যমে অস্থায়ী এমএফএস লাইসেন্স নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে ।তবে এনবিএফআই হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে সম্পতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদের জন্য 'নগদ ফাইন্যান্স পিএলসি' নামে একটি লাইসেন্স ইস্যু করেছে। দেশে ১৩টি এমএফএস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত বছরের জুন শেষে নগদের গ্রাহক ছিল ৬ কোটি ৪৭ লাখ।
(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/ মাহা/১১ জুন,২০২৩)