আগুনের প্রভাব এখনো কাটিয়ে উঠেনি বঙ্গবাজার
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: চলতি বছর রোজায় ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় রাজধানীর বঙ্গবাজারের সাতটি মার্কেট। ঈদুল ফিতরের আগ মুহূর্তে এমন দুর্ঘটনায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন সেখানকার ব্যবসায়ীরা।
ঘুরে দাঁড়াতে অনেকে ধার-দেনা করে অস্থায়ীভাবে দোকান বসালেও খুব একটা বেচাকেনা হয়নি। ব্যবসায়ীদের আশা ছিল আসছে ঈদুল আযহায় ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেবেন। কিন্তু ঈদ ঘনিয়ে এলেও প্রত্যাশিত বেচাকেনা নেই দেশের অন্যতম বড় এই পাইকারি ও খুচরা পোশাকের বাজারে। এতে দোকান খরচের টাকা তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীদের।
বঙ্গবাজারের বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে হাতেগোনা কয়েকজন ক্রেতা দেখা গেছে। বেচা-কেনা না থাকায় শুয়ে-বসে অলস সময় পার করছেন অনেকে। বিগত বছরগুলোয় যেখানে তারা দম ফেলার সুযোগ পান না, সেখানে তারা খুচরা পোশাক বিক্রি করতে পারছেন না। পাইকারি পোশাক বিক্রির বিষয়টি তো এখন কার্যত চিন্তার বাইরে।
যদিও ঈদুল আযহায় কোরবানির পশু কেনার কারণে নতুন জামা-কাপড় কেনায় খুব একটা আগ্রহ থাকে না সাধারণ মানুষের। তারপরও বড় এ উৎসব ঘিরে সাধারণ সময়ের তুলনায় পোশাক কেনাবেচা কিছুটা লক্ষ্য করা যায় মার্কেটগুলোয়। তবে এবার সে চিত্র নেই বঙ্গবাজারে।
বেচাকেনায় এমন ভাটা পড়ার কারণ হিসেবে বিক্রেতারা জানান, আগুনে সর্বস্ব হারানোয় ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পোশাক তুলতে পারছেন না তারা। আগুনের ঘটনার পর থেকে নির্দিষ্ট ক্রেতাদেরও অনেকে এখন আর এই বাজারে আসেন না। এমনকি অনেকে জানেনও না বঙ্গবাজারে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া বর্তমান মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও মানুষের হাতে বিলাসিতা করার মতো অর্থ না থাকাকে কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ফাস্ট চান্স নামে একটি প্যান্টের দোকানের বিক্রেতা মো. মহসীন বলেন, কোরবানির ঈদে মানুষ গরু-ছাগল কেনায় ব্যস্ত থাকে। জামাকাপড় কিনতে আসে না। তারপরও ঈদকে ঘিরে যে পরিমাণ ক্রেতা আসার কথা, তা নেই। মানুষের হাতে টাকা-পয়সা নেই, জামা কাপড়েরও দাম বেশি। তাই বেচা-বিক্রি নেই।
মীম গার্মেন্টস নামে টি-শার্টের দোকানের মালিক রেজাউল করিম বলেন, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আমার দুইটি দোকান ছিল। আগুনে পুড়ে দুটিই ছাই হয়ে গেছে। কিছু বাইর করতে পারিনি। হাতে টাকা না থাকায় রোজার ঈদে বেচাকেনা করতে পারিনি। ভাবছিলাম কোরবানির ঈদে কিছুটা ক্ষতি পোষানো যাবে। তাই ধার-দেনা করে এবং ব্যাংকের জমানো টাকা দিয়ে নতুন করে কিছু পোশাক তুলছি। কিন্তু কোরবানির ঈদের অবস্থা আরও খারাপ। মানুষ নাই, বেচা-কেনাও নাই। আগে কোরবানির ঈদে প্রতিদিন ৪০-৫০ হাজার টাকার বেচাকেনা হইতো। কিন্তু এবার দৈনিক ১০ হাজার টাকার জামাকাপড়ও বেচতে পারছি না। মানুষেরই বা দোষ কি? তাদের হাতে টাকা নাই, বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম বেশি। মানুষের জীবন চালাতেই তো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পোশাক কিনবে কীভাবে?
বিসমিল্লাহ গার্মেন্টসের কর্মচারী সালাউদ্দিন বলেন, ঈদ হিসেবে যেমন বেচাকেনা হওয়ার কথা, তেমন বেচাকেনা নেই। আগে প্রতিদিন ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা বিক্রি হতো। কিন্তু এখন ২০-৩০ হাজার টাকা বিক্রি করতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আগে বড় দোকান ছিল, বিক্রিও ভালো হতো। এখন সেই দোকানও নেই, বিক্রিও নেই। তাছাড়া বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়ায় এবার জামাকাপড়ের দামও বেশি। কিন্তু মানুষের হাতে টাকা নেই। তাই ক্রেতাও নেই।
মায়ের দোয়া গার্মেন্টসের মালিক আনোয়ার হোসেন সুমন বলেন, আগের মতো পার্টি আসে না। অনেক পার্টি জানেও না যে এখানে আবার নতুন করে দোকান বসছে। আগুনের ঘটনার পর বঙ্গবাজারে অনেক ক্রেতা অন্য জায়গায় চলে গেছে। অনেক পার্টির কাছে টাকা বাকি আছে। তারাও আসে না। এখন যে বেচাকেনা হচ্ছে, তা দিয়ে কোনোমতে কর্মচারীর বেতন ও কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে।
একই কথা বলছেন বঙ্গ ইসলামিয়া সুপার মার্কেট ও এনেক্সকো টাওয়ারের ব্যবসায়ীরাও। বঙ্গ ইসলামিয়া সুপার মার্কেটের আল্লাহর দান গার্মেন্টসের বিক্রেতা মেহেদি হাসান বলেন, বঙ্গবাজারে পাইকারি-খুচরা কারোরই বেচাকেনার অবস্থা আগের মতো নেই। বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম বেশি। মানুষ এখন হিসাব করে কেনাকাটা করছে। তাই আমাদের বেচাকেনা অর্ধেকের বেশি কমেছে। গত বছর কোরবানির ঈদে প্রতিদিন এক-দেড় লাখ টাকা বিক্রি করেছি। এবার ৫০-৬০ হাজার টাকাও বিক্রি হচ্ছে না। বেচাকেনা না থাকায় দোকান খরচ দিয়ে আর কিছু থাকে না। উল্টো প্রতিনিয়ত চালান শেষ হয়ে যাচ্ছে। আয়ের থেকে ব্যয় বেশি।
এনেক্সকো টাওয়ারের রবিন নিউ জেন্টস কালেকশনের বিক্রেতা টিপু সুলতান বলেন, আগুন লাগার পর থেকে মানুষ আতঙ্কে আর বঙ্গবাজার আসছে না। আগে যেখানে পাইকারি বিক্রি করতাম শুধু এখন সেখানে খুচরাও বিক্রি করতে কষ্ট হয়ে যায়। অবস্থা এমন যে দোকান ভাড়া, কারেন্টের বিল, কর্মচারীর বেতন দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের একেবারে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ১ দশমিক ৭৯ একর খোলা জায়গায় এখন বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে অস্থায়ীভাবে দোকান বসিয়ে বেচা-বিক্রি শুরু করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। গত রোজার ঈদের সময় শুধু চৌকি ও মাথার ওপর একটি ছাতা নিয়ে তীব্র গরমের মধ্যে বেচাকেনা করতে হয়েছিল তাদের। সেটিই এখন কিছুটা পাকাপোক্ত হয়েছে। বিদ্যুতের লাইন লাগানোয় সেসব দোকানে মাথার উপর ফ্যানও ঘুরছে। এতে ভোগান্তি কমেছে, কিন্তু দোকানিদের খরচ করতে হয়েছে ১০-২০ হাজার টাকা।
গত ৪ এপ্রিল ভয়াবহ আগুন লাগে বঙ্গ ইসলামীয়া মার্কেট, বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্স, বঙ্গবাজার মার্কেট, এনেক্সকো টাওয়ার, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেটে। ফায়ার সার্ভিস ঢাকার সবগুলো ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে নামে। বিমান, নৌ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরাও এ তৎপরতায় যোগ দেয়। ৬ ঘণ্টা লড়াই করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও, পুরোপুরি নির্বাপণ করতে সময় লেগে যায় ৭৫ ঘণ্টা। এ ঘটনায় বঙ্গবাজারের চারটি মার্কেট পুরোপুরি ও তিনটি মার্কেট আংশিক পুড়ে ছাই হয়ে যায়।