পদ্মা সেতুর এক বছর: দক্ষিণ-পশ্চিমের অর্থনীতিতে সুদিন
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: রাজধানী থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় একবছর আগে যেতে পার হতে হতো ফেরি। দুই ঈদে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে যানজট লেগেই থাকতো, এতে প্রচণ্ড ভোগান্তি পোহাতে হতো জনসাধারণকে।
বিপদ ছিল শীতেও, ঘন কুয়াশায় সারারাত বন্ধ থাকতো ফেরি। এছাড়া বর্ষায় ছিল লঞ্চ দুর্ঘটনার শঙ্কা।
সব শঙ্কা আর দুর্ঘটনার পথ মাড়িয়ে পদ্মা সেতু চালুর পর বৃহত্তর যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, বরিশাল আর ফরিদপুরের ২১ জেলার মানুষ ১ থেকে ৪ ঘণ্টার পৌঁছে যাচ্ছেন রাজধানীর বুকে।
আগে যেখানে ঢাকায় কোনো কাজ করতে গেলে যাওয়া-আসা মিলিয়ে সময় লাগতো তিনদিন, সেখানে এখন ভোরে ঢাকায় রওয়ানা দিয়ে দিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যার গাড়িতে বাড়ির উদ্দেশ্যে পথদেওয়া যায়। আর রাতে বাড়ি ফিরে মায়ের কিংবা প্রিয়তমা স্ত্রীর রান্না খেতে পারেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষরা।
তেমনই একজন মাসুদ হোসেন। যশোরের ঝিকরগাছার মাছ ব্যবসায়ী মাসুদ ২৪ জুন (শনিবার) ভোর ৪ টায় মাছ নিয়ে এসেছেন রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে। দুপুর তিনটা ৩০ মিনিটে তিনি জানান, দুপুর একটার ভিতরে মাছ বিক্রি করে ফেলেছেন, টাকাও পেয়েছেন। রাজধানীতে কিছু কেনাকাটা করে সন্ধ্যা ৬ টায় ভাড়া করা পিকআপ ভ্যানেকরে রওয়ানা দেবেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।
তিনি আরও বলেন, আগে রাজধানীতে পৌঁছাতে সময় লাগতো ৮-৯ ঘণ্টা। কাজ করে ফেরা যেতো না। অতিরিক্ত থাকা-খাওয়ার খরচ লাগতো। পদ্মা সেতু হওয়ায় কমে গেছে যাবতীয় খরচ।
পদ্মা সেতুরউদ্বোধন ও টোল আদায়
২০২২ সালের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করার পরে চলতি মাসের ৭ জুন পর্যন্ত টোল আদায় করা হয়েছে সাত শত আটান্ন কোটি আট লাখ সাতশ’ পঞ্চাশ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে টোল আদায় হলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে নির্মাণ ব্যয় উঠে আসবে। অন্যদিকে প্রতিবছর যদি ১০ শতাংশের বেশি হারে টোল আদায় হয় তবে ২০ থেকে ২২ বছরের মধ্যে উঠে আসবে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়।
কোরবানি ঈদেসুবিধা পাচ্ছেন পশু ব্যবসায়ীরাও
শনিবার (২৪ জুন) সরেজমিনে পদ্মা সেতু এবং এক্সপ্রেসওয়ে ঘুরে দেখেবাংলানিউজের মাদারীপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা কোরবানির পশুবাহী ট্রাকগুলো সেতু পার হয়ে ঢাকার দিকে ছুটছে। পশু নিয়ে হাটে যেতে আগের মতো কোনো দুশ্চিন্তা বা উৎকণ্ঠা দেখা যায়নি ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কারণ, দিন-রাত যেকোনো সময়েই পদ্মা পার হচ্ছেন তারা।
পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজা সূত্রে জানা গেছে, সকাল থেকেই কোরবানির পশুবাহী ট্রাক পদ্মা সেতু পার হচ্ছে, যার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই। সংখ্যায় বেশি হলেও টোল প্লাজায় কোনো যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে না।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পদ্মায় সেতু চালু হওয়ার পর কোরবানির পশু নিয়ে ঢাকায় যেতে কোনো ভোগান্তি নেই। কিন্তু সেতু চালুর আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরিতে উঠার অপেক্ষায় ঘাটে বসে থাকতে হতো। কখনও ফেরি পার হতে না পেরে ফিরে যেতে হতো। দীর্ঘ সময় ঘাটে আটকে থেকে গরমে গরু মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক।
দক্ষিণ-পশ্চিমের মাছ-সবজি রাজধানীতে বাধাহীন প্রবেশ
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী কৃষিনির্ভর দুই জেলা যশোর ও ঝিনাইদহ। দু’জেলার মধ্যবর্তী স্থান যশোরের সাতমাইল বাজার হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সবজির পাইকারি কেনাবেচার হাঁট। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সবজি কিনে নিয়ে যায়।
এ দু’জেলা ও পার্শ্ববর্তী মাগুরা জেলায় উৎপাদিত হয় ফুল, ফলসহ সব ধরনের সবজি। যা জেলা তিনটির অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে পাঠানো হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। আগে এসব কৃষিপণ্য ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো ছিল অনেক সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। কিন্তু ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এ জেলার কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সুদিন ফিরেছে। খুব সহজেই ঢাকাসহ সারাদেশের পাইকারি বাজারে পৌঁছে যাচ্ছে এখানকার কৃষিপণ্য।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় আগে যেখানে ৭ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগতো সেখানে এখন সময় লাগছে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। আগে ঘাট দ্রুত পার হওয়ার জন্য ট্রাক প্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা নেওয়া হতো। এখন সেতু হওয়ায় পথে কোথাও চাঁদাবাজি নেই।
সাতমাইল এলাকার আবু তোহা জানান, পদ্মা সেতু চালুর আগে বিভিন্ন পণ্য ঢাকায় পাঠাতে সময় লাগত ৮-১০ ঘণ্টা। ফেরি পারাপারে দেরি হওয়ার কারণে অনেক সময় নষ্ট হতো মূল্যবান এসব কৃষিপণ্য। এতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি লোকসান গুণতে হতো কৃষকদেরও। কৃষকরা দাম পেতেন কম। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দ্রুত সময়ের মধ্যে কৃষিপণ্যনির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ায় ভালো দাম পাচ্ছেন কৃষকরা।
স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের বিড়ম্বনা
পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় অভূতপূর্ব সাড়া ফেললেও স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের বিশেষ করে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও ফরিদপুরের সদরপুর, চরভদ্রাসন, ভাঙ্গা, অংশের ভোগান্তি অনেকটা রয়েই গেছে। এসব এলাকার যাত্রীদের লোকাল বাস সার্ভিসেই যেতে হয়। লোকাল বাসে ঢাকা পৌঁছাতে সময় লাগেস্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। পথে পথে একাধিকবার বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানামা এবং গাদাগাদি করে যাত্রী বহনের কারণে এক প্রকার দুর্ভোগ থেকেই যাচ্ছে। ভাড়াও গুণতে হয় অনেক বেশি। জনপ্রতি ভাড়া প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
বাংলানিউজের মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, জেলা শহরগুলো (ফরিদপুর অঞ্চলের ৫ জেলা) ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও গোপালগঞ্জ থেকে যে বাসগুলো ছেড়ে আসে, সাধারণত পথে এরা যাত্রী ওঠায় না। মাদারীপুর শহর থেকে ছেড়ে আসা পরিবহনগুলো সরাসরি ঢাকা পৌঁছায়। এছাড়াও দূরবর্তী অন্যান্য জেলার পরিবহনগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে চলাচল করে। ফলে সেগুলোতে করে স্বাভাবিক সময়েই পৌঁছানো যায় রাজধানীতে।