দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হাফিজ মুহম্মদ হাসান বাবু বলেন, পুঁজিবাজারের সমস্যা একদিন আলোচনা বা সেমিনার করে সমাধান করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় আমাদের একটি মাল্টিডাইমেনশন বডি তৈরি করা দরকার। তারা সঠিক পর্যালোচনার মাধ্যমে কিভাবে বাজারকে উঠানো যায়, সে দিক-নির্দেশনা তৈরি করবে। যেটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা দিতে পারবো। আমি মনে করি, পুরো পুঁজিবাজারকে সামনে রেখে একটি গাইডলাইন তৈরি করার পাশাপাশি বিভিন্ন আইনের দুর্বলতাগুলোকে এক জায়গায় এনে সমাধান করতে হবে। তাহলেই কেবল পুরো পুজিবাজারের উন্নয়ন হবে।

সোমবার (২১ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর নিকুঞ্জে ডিএসই টাওয়ারে মার্চেন্ট ব্যাংকারদের সঙ্গে তালিকাভুক্তি সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

কোম্পানি তালিকাভুক্তির প্রতিবন্ধকতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের অনেক বাধা রয়েছে। যেমন-উদ্যোক্তাদের মানসিকতা, আমলাতন্ত্র, সঠিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া, আইপিওর দীর্ঘসূত্রিতা, বহুজাতিক কোম্পানির ক্ষেত্রে মূল দেশ থেকে তহবিল প্রাপ্তি, রাজস্ব গোপন করার প্রবণতা, নীতির অসামঞ্জস্যতা, কর বৈষম্য, ব্যাংক এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহজে ঋণ ইত্যাদি৷ আজকের বৈঠকের মাধ্যমে আমাদের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ উঠে আসবে এবং সে অনুযায়ী আমরা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করব। এছাড়াও অঞ্চলভিত্তিক রোড শো আয়োজনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাগণকে তাদের ভাল কোম্পানির তালিকাভুক্ত করতে উত্সাহিত করব৷ এক্ষেত্রে একটি নতুন কর্ম কৌশল নিয়ে কাজ করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি), বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), স্টক এক্সচেঞ্জ, বিএমবিএ, আইসিএবি এবং এফআরসি এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে৷

কোম্পানি তালিকাভুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এশিয়ার অন্যান্য স্টক এক্সচেঞ্জের তুলনায় বাংলাদেশে মার্চেন্ট ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি থাকা সত্বেও গত কয়েক বছর ধরে পুঁজিবাজারে ভালো মানের আইপিও তালিকাভুক্তি হয় নাই ৷ বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৮টি মার্চেন্ট ব্যাংক কাজ করছে কিন্তু নতুন আইপিও আনার অনুপাত অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম৷ ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে ২১৬টি মার্চেন্ট ব্যাংক আছে এবং সেখানে ২২১৩টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত। পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জে ১৩টি মার্চেন্ট ব্যাংক ৫২৪টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত করেছে৷বোরসা মালয়েশিয়ার ও কলম্বো স্টক এক্সচেঞ্জে ইস্যু ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি অনুযায়ী গড় তালিকাভুক্ত কোম্পানি যথাক্রমে ২৪ এবং ১২টি৷ ডিএসই গড় মাত্র ৫টি। আরও অধিক আইপিও আনতে আমাদের যৌথভাবে কাজ করতে হবে এবং ইস্যু ম্যানেজারদের সক্রিয় হতে হবে। এ বিষয়ে যেকোন ধরনের সহযোগিতা ডিএসই করবে এবং সুন্দর আগামীর পুঁজিবাজার গঠনে আমরা একসাথে কাজ করবো।

জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদানের কথা প্রসঙ্গে ডিএসই চেয়ারম্যান বলেন, পুঁজিবাজারের গভীরতা অর্জনে ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন স্থানীয় ও বহুজাতিক কোম্পানি দ্রুত তালিকাভুক্তকরণের কোন বিকল্প নেই। আর এ বিষয়ে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে অবদান রাখতে হবে৷ এ কাজগুলো করতে পারলে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে৷ পুঁজিবাজারের সেতুবন্ধক হিসেবে আপনারা বাজারে বিনিয়োগকারী ও কোম্পানিগুলোকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রত্যাশিত পুঁজিবাজার গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন৷

প্রাইভেট বন্ড সম্পর্কে ড. হাসান বাবু বলেন, ১৬ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা মূল্যের ৪২টি প্রাইভেট বন্ড এটিবি প্ল্যাটফর্মে তালিকাভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। ছোট পুঁজির প্রয়োজনে এসএমই প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদেরকে কিভাবে পুঁজিবাজার মুখী করা যায় এবং কিভাবে পরামর্শ সেবা দেয়া যায় সেটা নিয়ে আমরা যৌথভাবে কাজ করতে চাই৷

চেয়ারম্যান বলেন, শক্তিশালী পুঁজিবাজার বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের জন্য অপরিহার্য৷ আর উন্নয়ন ও উৎপাদন কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা এলে বিদেশি বিনিয়োগ পুঁজিবাজারমুখী হতে উৎসাহিত হয়৷ দেশের শেয়ারবাজার এখন অনেক পরিণত। তাই উদীয়মান পুঁজিবাজারকে উন্নয়নের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নিয়ে এবং সেখানে জমে ওঠা বিপুল পরিমাণ মূলধনের একাংশ উৎপাদনশীল খাতে স্থানান্তর করে অর্থনীতির মূল স্রোতে যুক্ত করা প্রয়োজন৷ বাংলাদেশের অর্থনীতির সকল সূচক ইতিবাচক থাকার কারণে পুঁজিবাজারের উন্নয়নের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে৷ আর এ জন্য পলিসি সাপোর্টের দিকে না তাকিয়ে সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে৷ সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ পুঁজিবাজারকে একটি শক্ত অবস্থানে নিবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস৷

সভায় ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এম সাইফুর রহমান মজুমদার স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, ডিএসই পুঁজিবাজারের সকল মার্চেন্ট ব্যাংকার্স প্রতিনিধিদের সাথে তালিকাভুক্তি সংক্রান্ত সমন্বয় সভা করছেন মূলত: বাজারের গভীরতা বৃদ্ধি তথা ভালো কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে৷ মার্চেন্ট ব্যাংকের প্রধান কাজ হচ্ছে পুঁজিবাজারে ভাল ভাল কোম্পানি তালিকাভূক্ত করা। যা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে প্রতি আকৃক্ট করে। ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর জন্য সময়োপযোগি ব্যবসায়িক মডেল তৈরীর ওপর গুরুত্বারোপ করেন৷

এদিকে বিএমবিএ’র প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে যখন প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হলে তাদের লাভ কি সে বিষয়ে জানতে চায়। কিন্তু মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো তাদেরকে লাভের বিষয়ে বলতে পারে না। কারণ মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোই জানে না যে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানিগুলোর কি লাভ হবে। বাজারে তালিকাভুক্তি ও বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছে। তাদেরকে বেশ কিছু বিষয় বুঝানো হয়েছে। দীর্ঘদিন বুঝানোর ফলে বিএসইসি অনেক কিছু আমলে নিলেও এনবিআর এখনো কোনো বিষয় আমলে নেয়নি। ফলে তালিকাভুক্ত হলে কোনো লাভ হবে না দেখে কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হচ্ছে না।

তিনি বলেন, বর্তমানে কোম্পানিগুলো ব্যাংক নির্ভরতা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে কোম্পানির এক দেড় বছর সময় লাগে। কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে সময় লাগে দুই থেকে তিন মাস। সেক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্বুদ্ধ করা না হলে, কখনো তালিকাভুক্তির পরিমাণ বাড়ানো যাবে না। সরকারি হিসেবে, কোম্পানি আছে ২ লাখের বেশি। যার মধ্যে মার্কেটে আছে ৩৫০টি, যা ২ শতাংশের কম। কারণ তাদের তালিকাভুক্ত হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তিন বছরের মধ্যে তালিকাভুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায়, সময় বেশি লাগলেও বর্তমানে পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বেশি রয়েছে।

বিএমবিএ প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, মার্চেন্ট ব্যাংকের অবস্থার উন্নয়ন করতে পারলে আইপিও বাড়বে। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে বাধাগ্রস্ত হয়। তাদেরকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো কর দিতে হচ্ছে। কিন্তু তারা অর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুযোগ সুবিধা পায় না এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয় না। এ সময় তিনি তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হারের ব্যবধান বাড়ানোর বিষয়টি এনবিআরকে আবারো বিবেচনা করার আহ্বান জানান।

এছাড়া সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ডিএসই’র প্রধান নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা খাইরুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ, লংকা বাংলা ইনভেস্টমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আলম, আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেনারেল ম্যানেজার মাজেদা খাতুন, আইডিএলসি ইনভেস্টম্যান্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজা উদ্দিন আহমেদ, এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান।