মাহি হাসান, দ্য রিপোর্ট:  নানামুখী চেষ্টা করেও দীর্ঘমেয়াদে টেনে তোলা যাচ্ছে না পুঁজিবাজার। কোন সুসংবাদই দেশের পুঁজিবাজারকে ফেরাতে পারছে না কাঙ্ক্ষিত পথে। যদিও এই সপ্তাহে গত দুইদিন পুঁজিবাজারে লেনদেন ও সূচক কিছুটা বেড়েছে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আজও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার নিজস্ব শক্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। তাই গুজব কিংবা কারসাজি সহজেই বাজারকে প্রভাবিত করে। নানাধরণের গুজব ছড়িয়ে একাধিক কারসাজি চক্র বাজারের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে।

গুরু পাপে লঘু দণ্ড দিলে কারসাজি থামানো যায় না। গত ৮ই আগস্ট অনুষ্ঠিত ‘পুঁজিবাজারে নারী’ শীর্ষক এক সেমিনারের আলোচনায় ইকোনোমিক্স রিপোর্টার্স ফোরামের সাবেক সভাপতি শারমীন রিনভী এ বিষয়টি উল্লেখ্ করে বলেন ‘সরিষায় ভুত’ থাকলে সে ভুত ছাড়াবে কে? তিনি বলেন , "কারসাজি করে ৫ কোটি টাকা মুনাফাকারীকে ৫ লাখ টাকা জারিমানা করা হয় তাই কারসাজি থামে না। বিএসইসি রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাধরকে শাস্তি দিতে পারছে না"। আয়োজিত এই সেমিনারে প্রধান অতিথির ছিলেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড একচেঞ্জ কমিশন চেয়ারম্যানঅধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন সবদেশেই কারসাজিচক্র সক্রিয় থাকার চেষ্টা করে। কিন্ত কোথাও তারা নিয়ন্ত্রকের আসনে বসার সুযোগ পায় না। সব দেশের বাজারেই উত্থান পতন হয়। একদিন উত্থান হলে পরের দিন পতন হয় বা এক সপ্তাহ উত্থান তো পরের সপ্তাহে পতন। এমন উত্থান-পতনেই চলে পুঁজিবাজার। একটি স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা থাকে। কোন শেয়ারের দাম বাড়ে কোন শেয়ারের দাম কমে। কিন্তু বাংলাদশের পুঁজিবাজারের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। দেশের পুঁজিবাজারে দেখা যায় ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে অন্যদিকে বন্ধ কিংবা অচল কোম্পানির শেয়ারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। এটি মার্কেটের অদ্ভুত এক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডিবিএইচ ফাইন্যান্সিয়াল, আর্থিক খাতের একটি কোম্পানি যা ২০১৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত প্রত্যেক বছরই কমপক্ষে ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। বর্তমানে এই শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ৫৬ টাকা ৭০ পয়সায়। আবার রহিমা ফুড কর্পোরেশন নামে আরেক কোম্পানি। যারা ২০২১ সালে ১ শতাংশ ও ২০২২ সালে ৫ শতাংশ হারে মুনাফা দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের। এই কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ২৩৭ টাকা ৭০ পয়সায়। পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম্যই পুঁজিবাজারকে নিজস্ব গতি পথের প্রধান বাঁধা। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাজারকে চলতে হবে নিজস্ব গতিতে, নিজের শক্তিতে পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে কারসাজি চক্রের যথোপোযুক্ত শাস্তি। এদিকে, মন্দাবাজার ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন অনেক বিনিয়োগকারী।পুঁজিবাজারের তথ্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত সিডিবিএল সুত্রে এমন তথ্যের প্রমাণ মিলেছে। সিডিবিএলের তথ্যমতে, দুই মাসে বিনিয়োগকারিদের বিও একাউন্টের সংখ্যা কমেছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৪৩৫টি। বর্তমানে (১৭ই আগস্ট পর্যন্ত) বিও একাউন্টের সংখ্যা ১৭ লাখ ৪৫ হাজার ৫৩৩টি। এর ঠিক দুই মাস আগে অর্থ্যাৎ জুন মাসের ১৮ তারিখ বিনিয়োগকারীদের বিও একাউন্টের সংখ্যা ছিলো ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৯৬৮। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার বিমুখ হবার পেছনে রয়েছে অনেক কারন। যার মধ্যে আস্থাহীনতা বড় একটি কারণ। সব কিছু ছাপিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার মূল কারণ বিচারহীনতা।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট উর্ধবতন ব্যক্তিদের সম্পর্কে নানা ধরনের অভিযোগ, দেশের সামগ্রিক রিজার্ভ কমে যাওয়ার গুজবসহ নানা আতঙ্ক বাজারের পরিবেশ নষ্ট করেছে বলে মনে করে হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হ্যাকের হুমকিসহ নানা প্রতিকূল বিষয় বাজারকে অস্থির করে তুলেছে বলে ধারণা অনেকের। এ কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও কারসাজিচক্রের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। এ ব্যাপারে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, "জুয়ারীদের বিচার নিশ্চিত করা না গেলে বিনিয়োগকারী ফিরবেনা বাজারে। দুইদিন ভালো যাবে আবার আগের অবস্থায় ফিরবে বাজার। এটি এখন নিয়ম হয়ে গেছে"। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড একচেঞ্জ কমিশনের প্রতি উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, "পুঁজিবাজার আগের অবস্থায় ফেরাতে হলে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে অবশ্যই সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে"। বাজারের মন্দার পেছনে কারসাজিকারীদের নীরবতাকেও কারণ হিসেবে মনে করেন একাধিক বিনিয়োগকারী। হারুন হাসান নামে মতিঝিলের একটি ব্রোকারেজ হাউজের বিনিয়োগকারী বলেন, "বাজারে সম্ভবত কারসাজি চক্র চুপচাপ"। এত বছর পরে এসেও কারসাজি চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে এই ধারনা থেকে বের হতে পারেনি পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। ২০২০ সালের মে মাসে দায়িত্ব নিয়েছে বর্তমান কমিশন। বিনিয়োগকারিদের আস্থা ফেরানোর জন্য নিয়েছে নানা ধরনের পদক্ষেপ। কিন্তু দিন দিন আস্থা কমেছে। প্রধান কারণ কারসাজি চক্রের সাথে কমিশনের সখ্যতা, বিশাল কারসাজির বিপরীতে নূন্যতম শাস্তি ইত্যাদি। কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম্য কমাতে সম্প্রতি বিএসইসি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা কাজে লাগেনি। ১০ কোটি টাকার কারসাজি করেছে কিন্তু শাস্তি পেয়েছে ২০ লাখ টাকা। যা কারসাজির তুলনায় নূন্যতম। আবার ২০টি কোম্পানির কারসাজি করে শাস্তি পায় ২টির জন্য, এরুপ একাধিক রেকর্ডও আছে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ গত বছরের নভেম্বরে মাত্র ১৫ দিনের কারসাজিতে এক ব্যাংকের শেয়ার লেনদেনে ১৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা মুনাফা তুলে নেন আলোচিত এক সরকারি চাকুরিজীবি বিনিয়োগকারী আবুল খায়ের হিরু। এ ঘটনার জন্য নিয়ন্ত্রক বিএসইসি সেই বিনিয়োগকারীর বাবা ও তাঁর সহযোগীদের ৩ কোটি টাকা জরিমানা করে। এ ধরণের অবস্থা প্রায় সারা বছরই চলছে। সারা বছরই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে “দায়মুক্তির শাস্তি” পাচ্ছেন কারসাজি চক্রের সাথে জড়িত ব্যাক্তিরা।

বর্তমানে বাজারের পতনের মূল কারণ কি এই প্রশ্ন করলে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিনিয়োগকারী বলছেন, বর্তমানে কারসাজি চক্র কিছুটা নীরব তাই হয়তো বাজার খারাপ। পুঁজিবাজারের এত বছর পরেও এসেও বিনিয়োগকারীদের এরুপ চিন্তাভাবনা এর দায় কি নিয়ন্ত্রক সংস্থা এড়াতে পারেন? অনেক বিনিয়োগকারী মনে করেন, বর্তমানে কারসাজি চক্র নিজেদের ইচ্ছামতো বাজার পরিচালনা করছে। যখন ইচ্ছে দাম বাড়ানো যখন ইচ্ছে কমানো। দেখা যায় কম মুলধনী কোম্পানিগুলোর শেয়ার দাম বাড়ছে কিন্তু এসব কোম্পানি লভ্যাংশ দেয় না। বিপরীতে ভালো কোম্পানির যেসব কোম্পানি নিয়মিত লভ্যাংশ দেয় শেয়ারের দাম সেভাবে বাড়েও না, কমেও না। ফলে এক শ্রেনির বিশ্লেষধর্মী বিনিয়োগকারী যারা ভালো কোম্পানি দেখে বিনিয়োগ করেন, বাজারে বুঝে বিনিয়োগ করেন তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েন। মুখ ফিরিয়ে নেন বাজার থেকে। এভাবে এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী মার্কেট ছেড়ে দেয়। আবার খারাপ কোম্পানিতে কারসাজির চক্রের দ্বারা প্রতারিত হয়ে যারা বিনিয়োগ করেন এদের মধ্যে যারা শুরুতে অল্প লাভে শেয়ার বিক্রয় করে দেন তাঁরা বেশি দামে শেয়ার বিক্রি নিয়ে বের হয়ে যান। আর যারা দাম বাড়ছে দেখে শেয়ার ধরে রাখেন তাঁরা বিশাল ক্ষতির মুখে পড়েন। এরাই মূলত কারসাজির চক্রের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড হোটেলের শেয়ারের দাম গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ৯ই মার্চ এ ছয় মাসে একটানা বেড়ে ৫৭ টাকা থেকে ৩২০ টাকায় উঠে যায়। তাতে মাত্র ছয় মাসে সি পার্লের শেয়ারের দাম ২৬৩ টাকা বা ছয় গুণ বেড়ে যায়। এরপর থেকে শুরু হয় পতন। যা এখনো বিদ্যমান। সর্বশেষ কার্যদিবসে (২১শে আগস্ট) শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ১৮৩ টাকা ৫০ পয়সায়। মার্চ মাসের পতন শুরুর আগে যারা শেয়ারটি কিনে বিক্রি করে দিয়েছেন তাঁরা লাভবান হয়েছে। যারা এই সময় পরেও শেয়ারটি ধরে রেখেছেন আরো মুনাফার আশায়, তাঁরা পড়েছেন ক্ষতির মুখে। অস্বাভাবিক উত্থানের পর দ্রুত যখন দাম কমতে থাকে, তখন দেখা দেয় ক্রেতা–সংকট। ফলে বিক্রি করতে চাইলেও অনেকে শেয়ার বিক্রি করতে পারেন না। তাতে লোকসানের বৃত্তে আটকা পড়েন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। মার্চ মাস থেকে মে মাস ঠিক সেভাবেই লাফিয়ে লাফিয়ে দাম কমেছে যেভাবে দাম লাফিয়ে বেড়েছিলো। এভাবে বাজারের পতন ঘটতে থাকে। এই ধরনের বিনিয়োগকারীরাও পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থা হারান।

বাজারের সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার ড. শেখ শামছুদ্দিন আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন "যুদ্ধসহ সার্বিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি আমাদের অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলেছে নানাভাবে। যার মধ্যে জ্বালানী মুল্য একটি বিষয় যা মু্দ্রাস্ফীতিসহ নানাভাবে যোগান আর চাহিদাতে গভীর প্রভাব রাখছে। পুঁজিবাজারে এই প্রভাব ব্যাপক ,যা আস্থার সংকটসহ মন্দা তৈরি করছে। তাছাড়া, আরো কিছু বিষয় যেমন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের অভাব, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহন সক্ষমতার অভাব এবং নতুন ভাল প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তির অভাব রয়েছে"।যদিও বিএসইসি কমিশনার এই সমস্যাকে "সাময়িক" বলে আখ্যায়িত করেন। খুব দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশাবাদীড. শেখ শামছুদ্দিন আহমেদ। নিয়ন্ত্রক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তির কাছে প্রশ্ন থাকে, অনেক বিনিয়োগকারী মনে করেন কারসাজি চক্রের হাতে বাজার। এরা অংশগ্রহন না করলে বাজারে মন্দা অবস্থা থাকে। এই ধারনা কতটুকু সঠিক বা এই ব্যাপারে কমিশনের বক্তব্য কি? জবাবে কমিশনারড.শেখ শামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, "মুক্তবাজার অর্থনীতির পুঁজিবাজারে কিছু অনিয়ম কখনো কখনো হয়। কারসাজি বা সিন্ডিকেট এমনই একটি অনিয়ম। কোন অনিয়মই ভাল কিছু করেনা। নিয়ন্ত্রক সংস্হা হিসাবে আমরা সচেস্ট থাকি এইসব অনিয়ম প্রতিহত করতে"।

কমিশনারের কাছে দ্য রিপোর্টের প্রশ্ন ছিলো, কমিশনের সঙ্গে সখ্যতা রেখেই কারসাজিচক্র বাজারে গেমলিং করে যাচ্ছে এই ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। পাশাপাশি কারসাজির মাধ্যমে যে পরিমাণ মুনাফা করছে এর তুলনায় কম শাস্তি বা জরিমানা করা হয়। ফলে জড়িত রা কারসাজি করতে ভয় পায় না এই ব্যপারে কমিশন কি মনে করে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমরা অসংখ্য তথ্যানুসন্ধান এবং তদন্ত করি। এই কার্যক্রম যথেস্ট সময় সাপেক্ষ। অনুসন্ধান রিপোর্ট মোতাবেক অনেক ধরনের অসংখ্য শাস্তি দেই"।তিনি আরো বলেন,"আমরা চেস্টা করি এসব অভিযোগ ও শাস্তির অপ্রয়োজনীয় প্রচার না করতে। শাস্তির অভিযোগ আমলে নেয়ার মাত্রা আমরা ক্রমাগত বৃ্দ্ধি করছি। অনিয়মের বিস্তার রোধকল্পে শাস্তির মাত্রা প্রতিনিয়ত তীব্রতর হচ্ছে"। অনিয়মের বিরুদ্ধে আরো দ্রুত ও কার্যকর ভুমিকা রাখার জন্য "অনুসন্ধান এবং তদন্ত বিভাগ" নামে আমরা অধুনা একটি বিশেষ বিভাগ সৃস্টি করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড একচেঞ্জ কমিশন, এমনটাই জানান বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ।

(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/ মাহা/ ২২ শে আগস্ট দুইহাজার তেইশ)