পৃথিবীর তাপমাত্রা ১০০ বছরে বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস
তাপ বৃদ্ধিতে গলছে বরফ, তলিয়ে যাচ্ছে উপকূল, বাড়ছে দারিদ্রতা
মরিয়াম আক্তার মৌ, দ্য রিপোর্ট: বিশ্বব্যাপি আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের উপকূলে সরাসরি পড়তে শুরু করেছে। গত ১০০ বছরে পৃথিবীর ভূপৃষ্টের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। পানির স্তর বৃদ্ধি পেয়ে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উপকূলবর্তী অনেক এলাকা ইতোমধ্যে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। যেসব এলাকায় কখনো জোয়ারের পানি প্রবেশ করেনি সেসব এলাকায় পানি ঢুকে দীর্ঘ সময় ডুবে থাকছে। জোয়ারের পানিতে কক্সবাজার শহরের রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। কুয়াকাটার বিস্তৃর্ণ এলাকাতে একই অবস্থা। বিশ্বব্যাপি তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জমাট বরফ গলে গলে পানিতে রুপান্তরিত হয়েছে। যা সমুদ্রের পানিতে মিশে সমুদ্রের পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মতো সমুদ্রপৃষ্ট থেকে কম উচ্চতা সম্পন্ন দেশের উপকুলের মাটি বা ভুমি তলিয়ে যেতে শুরু করেছে।
কোনো স্থানের ৩০ থেকে ১০০ বছরের বেশি সময়ের আবহাওয়া অর্থাৎ বায়ুতাপ,বৃষ্টিপাত প্রভৃতির গড় হলো জলবায়ু। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা বলে আসছেন কার্বণ নি:সরণের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাতে বরফ গলে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যাবে। বাংলাদেশে সেই আশঙ্কা সত্যি হচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে ভূপৃষ্ট। বিশ্বব্যাপি বদলে যাচ্ছে তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, আদ্রর্তা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, তুষারপাত, বৃষ্টিপাত ও মেঘাচ্ছন্নতা। যা পৃথিবীর যে কোনো অংশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। সমূদ্রপৃষ্ট থেকে উচ্চতা বাংলাদেশের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় কম। মালদ্বীপ ও বাংলাদেশ সবার আগে তলিয়ে যাবে। জোয়ারের সময় বাংলাদেশে উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস সত্যি প্রমাণিত হতে চলেছে। জলবায়ু ও পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে দারিদ্র্যতার একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বহু মানুষ ভিটা ছাড়া হয়ে পড়ে। ফলে নিম্নআয়ের জনগণের উপর অতিরিক্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
খাদ্য উৎপাদন, জলসরবরাহ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, এবং আমাদের বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর প্রভাব ফেলছে।বিশেষত কৃষি-নির্ভর এদেশে জলবায়ুর পরিবর্তন খাদ্য নিরাপত্তা, পানির সরবরাহ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবাকে বেশি প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। এ পরিবর্তন ফসল উৎপাদন ও মাছ ধরার উপর নেতিবাচক ভূমিকা তৈরি করেছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও আয় সূচকে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
অনেকে নিজেদেরেকে খাপ-খাওয়াতে চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ পেশা বদলে ফেলেছেন। অনেকে এলাকা ছাড়া শুরু করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থহচ্ছে প্রকৃতির।পৃথিবীরঅধিকাংশ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মানবসৃষ্ট কারণকে চিহ্নিত করেছেন।জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চারটি প্রভাব ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীর মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে অসহনীয় গরম পড়ছে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে ভূ-পৃষ্ঠের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে। তাতে গাছপালা ও বন্য প্রাণী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, বন্যা ও জলাবদ্ধতা বেড়ে গিয়ে মানুষের দূর্ভোগ বেড়ে যাচ্ছে ।
আমাদের কক্সবাজার প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ নয়নের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনে কক্সবাজারের প্রকৃতির ও জনজীবনের ওপর কী ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে । এবারের বন্যায় কক্সবাজারেই মারা গছেে ২০ জন। পানির নীচে তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার বসতঘর, ফসলি জমি এবং চিংড়ি ঘের। প্রধান সড়ক, গ্রামীণ জনপদ, গবাধি পশু ও কার্লভাটসহ ব্যাপক ক্ষতগ্রিস্থ হয়।বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো এক জেলা থকেে অন্য জেলার যোগাযোগ। উপকুলীয় বাসিন্দারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে জেলার দীপাঞ্চল এবং নিম্নঞ্চালীয় বহু মানুষ বাস্তহারা হবে। নেমে আসতে পারে চরম দারিদ্রতা।
প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এবার বন্যায় ৯ উপজেলার ৬০ ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। টানা ৬ দিনে (৮ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্ট) পানিবন্দি ছিলেন ৫ লাখের বেশি মানুষ। পানির ঢল আর পাহাড় ধসে মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের। চকরয়িায় ১১ জন, পেকুয়ায় ৬ জন, উখিয়ায় ২ জন এবং রামুতে ১ জনরে মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে চকরিয়া-পেকুয়া উপজলো।কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষন কান্তি দাশ জানান, এবারের বন্যায় কেবল উপকুলীয় এলাকা নয়; ডুবেছে নতুন কিছু উঁচু স্থানও। যার একমাত্র কারণ জলবায়ু পরিবর্তন।
তিনি জানান, বন্যায় সড়ক বিভাগের ৫৯ কিলোমিটার সড়ক এবং এলজিইডির ৮০ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তা ও ৪৭টি ব্রিজ-কালর্ভাট বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতগ্রিস্থ হয়েছে। এছাড়া জেলায় ১৫ হাজার ৬৩৮ হেক্টর ফসলি জমি, ১ হাজার ৭৫২ টি পুকুর-দীঘি খামার, ১ হাজার ৮৩২ টি মৎস্য ঘের, ২৬২ মেট্রিক টন ফিন ফিস, ৭০০ মেট্রিক টন চিংড়ী ৯.৯৫ মেট্রিক টন পোনা ও ১৭৯ টি জাল ক্ষতগ্রিস্থ হয়েছে।
উপকূলীয় অঞ্চলে যেসব মানুষ কৃষি ও মৎস্য চাষ নির্ভর। এবার তারাই বেশী ক্ষতগ্রিস্থ হয়েছে এবং এতে করে ফসল ও মৎস্য উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। পেকুয়া উপজলোর মগনামা ইউনয়িনরে চাষী আবদুল মজদি (৪৩) বলেন, স্মরণকালরে এই ভয়াবহ বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠা অসম্ভব। আগে কখনো বন্যায় এত পানি হয়নি, ঋতু পরিবর্তনের কারণে এমনটা হচ্ছে বলে মনে করছেন এই কৃষক। চকরিয়ার বাসিন্দা মোবারক আলী জানান, বন্যার পানিতে সব শেষ হয়ে গেছে। এখনকি ঘর মেরামত করব নাকি চাষের জমি ঠিক করব বুঝতে পারছি না। এছাড়া পকেটেও টাকা নাই। জীবনটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। পরিবারের ভরণ-পোষণ নিয়েও চিন্তার কথা জানান তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তনে হুমকির মুখে পড়েছে র্পযটকদের অন্যতম আর্কষণীয় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কও। সম্প্রতি সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে তীব্র ঢেউয়ের আঘাতে সড়কটির অন্তত ১০ থেকে ১৫টি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বালুভর্তি ব্যাগ দিয়ে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পানির উচ্চতা না কমা পর্যন্ত পুরোপুরি ঠিক করা আনা সম্ভব নয়।
টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের বাহারছড়া ঘাট থকেে হাদুরছড়া বিজিবি ক্যাম্প র্পযন্ত ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সড়কটিতে এসব ভাঙন অব্যাহত। এতে মেরিন ড্রাইভের চোখ জুড়ানো সৌর্ন্দয্য বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি লোকালয়ে পানি প্রবেশের হুমকির মধ্যে রয়েছে দুই হাজার পরিবার।
স্থানীয়দের মধ্যে সাইফুল ইসালাম নামে এক ব্যক্তি জানান, অন্য বছরের চেয়ে এ বছরের ভাঙন তীব্র ও আগ্রাসী। জোয়ায়ের পানি ঢুকে উপকূলীয় এলাকা ডুবে যাচ্ছে। আগে কখনাে এরকম হতে দেখি নি।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ.ন.ম হেলাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর র্বষা মৌসুমে বৈরি আবহাওয়ার কারণে মেরিন ড্রাইভ ভাঙনের কবলে পড়ে। প্রতিবারই সংশ্লিষ্টরা বালিভর্তি ব্যাগ দিয়ে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। কিন্তু তাতে স্থায়ী সমাধান আসে না। তাই সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে মেরিন ড্রাইভটি রক্ষায় টেকসই উদ্যোগ নেওয়া জরুরী। সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে সৌর্ন্দয র্বধনকারী সবুজ বেষ্টনী ঝাউবাগান হুমকির মুখে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় র্বষা মৌসুমে সাগরের ঢেউয়ের ধাক্কায় ভাঙছে বালিয়াড়ি ও সড়ক। সমুদ্রর্গভে হারিয়ে যাচ্ছে সৈকতের ঝাউবাগান। গত ১০ বছরে বিলীন হয়েছে লক্ষাধিক ঝাউগাছ। দ্রুত সময়ের মধ্যে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সৈকতের বালিয়াড়িতে শেকড়যুক্ত গাছ রোপণের দাবি পরিবেশবিদদের।
স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭২-৭৩ সালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়ি ঝাউবাগান গড়ে তোলা হয়। এ সময় বালিয়াড়ির প্রায় ৫শ’ হেক্টর জায়গায় লাগানো হয় সাড়ে ১২ লাখের বেশি ঝাউগাছ। পরে বাগানের আয়তন আরো বাড়িয়ে এই সবুজ বেষ্টনী করা হয় যা বিশ্বের র্দীঘতম সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য বাড়ানোর পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে কক্সবাজার শহর রক্ষা করে।
তবে, জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় এবং ঢেউয়ের ধাক্কায় গত কয়েক বছর ধরে র্বষা মৌসুমে সৈকতের বালিয়াড়ির ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে, ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে ঝাউ বাগানের। গত ১০ বছরে ঝাউ বাগানের এক লাখের বেশি গাছ সমুদ্রর্গভে বিলীন হয়ে গেছে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক র্শমা দীপু জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কক্সবাজারে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ র্পযন্ত ১২০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতের পাড় ঘেঁষে যে ঝাউবাগান রয়েছে ইতোমধ্যে সেটির এক লাখের বেশি ঝাউ গাছ বিলীন হয়েছে।
তবে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান জানান, সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে তাই সৈকতের কলাতলী থেকে নাজিরারটেক র্পযন্ত পাঁচ কিলোমিটার এলাকা ভাঙনরোধে সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পর্যটন কর্পোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া ,চকরিয়া, রামু, খুরুশকুল, টেলনাফের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চলতি মৌসুমে বীজ বপন, শীতকালীন সবজি চাষেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে আশংকা করছেন নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা। এই চিত্র বাংলাদেশের ঊপকূলীয় একাংশ কক্সবাজারেও । গোটা বাংলাদেশের উপকূলে একই অবস্থা চলছে। পরিবেশের এই পরিবর্তনের কারণ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অংশ দেখুন আগামী পর্বে।
(দ্য রিপোর্ট/ ম আ মৌ/ টিআইএম/ মাহা/১ সেপ্টেবর,২০২৩)