নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন
লাখো মামলায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র আটকে আছে আদালতে
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: বাংলাদেশের আদালতের কক্ষগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই বিরোধী দলগুলোর হাজার হাজার নেতা–কর্মী এবং সমর্থকদের দাঁড়াতে হচ্ছে বিচারকের সামনে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সাধারণত ধোঁয়াশাপূর্ণ। একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে এসবের মধ্য দিয়ে একটি অচলাবস্থার প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির তথ্যমতে, তাঁদের ৫০ লাখ নেতা–কর্মীর প্রায় অর্ধেকই রাজনৈতিক মামলায় জর্জরিত। এর মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় নেতা এবং সংগঠকেরা কয়েক ডজন—এমনকি শত শত মামলার মুখে পড়েছেন।
সম্প্রতি এক সকালে সাইফুল আলম নীরব নামে বিএনপির এক নেতাকে হাতকড়া পরিয়ে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩১৭ থেকে ৩৯৪টি মামলার মুখোমুখি নীরব। আসলে তিনি এবং তাঁর আইনজীবীরাও ভালো করে জানেন না, তাঁর বিরুদ্ধে ঠিক কতগুলো মামলা আছে। আদালতের বাইরেও দলটির এক ডজন সদস্য ছিলেন—যারা অন্তত আরও ৪০০টি মামলার মুখোমুখি।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছে। এসব উন্নয়নের মধ্যে—গার্মেন্টস রপ্তানি শিল্পের ওপর নির্ভর করে দেশটিতে ডলারের স্থিতিশীল প্রবাহ রয়েছে। এই শিল্পটি অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষের দারিদ্র্য দূর করেছে। আমেরিকান কর্মকর্তারা একসময় দুর্ভিক্ষ এবং রোগের ঝুড়ি হিসেবে বর্ণনা করলেও দেশটি কয়েক দশক ধরে অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান এবং হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা কাটিয়ে উঠেছে।
কিন্তু এসবের বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার প্রজাতন্ত্রটিকে একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছেন বলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা অভিযোগ করছেন।
তাঁরা বলছেন, ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে শেখ হাসিনা পুলিশ, সামরিক বাহিনী এবং আদালতসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় লোকদের দিয়ে পূর্ণ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি ভিন্ন মতের শিল্পী, সাংবাদিক, কর্মী, এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করছেন।
আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সংঘাতময় পরিস্থিতির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার আগে বিরোধীরা এই নির্বাচনকে শেষ লড়াই হিসেবে দেখছেন। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগীরা কোনো শর্তেই বিএনপির বিজয়কে মেনে নিতে প্রস্তুত নন।
এক সাক্ষাৎকারে ঢাকার কার্যালয়ে শেখ হাসিনার কাছে জানতে চাওয়া হয়—বিরোধীদলকে হয়রানি করতে তিনি বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছেন কি না। এ সময় তিনি তাঁর এক কর্মীকে কক্ষের বাইরে পাঠান একটি ফটো অ্যালবাম নিয়ে আসার জন্য। ওই অ্যালবামটি ছিল মূলত অগ্নিসংযোগ, বোমা বিস্ফোরণ এবং হামলায় ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের গ্রাফিক ছবিতে পূর্ণ।
বিএনপি নেতাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাঁদের অনেক সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে, অনেককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন একই কাজ করেছিল। তাঁর দলের হাজার হাজার সমর্থককে জেলে ঢুকিয়েছিল, হত্যা করেছিল।
শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান নেতা ছিলেন। চার বছর পর একটি সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন এবং তাঁর পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রক্তক্ষয়ী বিশৃঙ্খলার ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় আসেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। তিনিও ১৯৮১ সালে সৈন্যদের হাতে নিহত হন। এরপর থেকে বেশির ভাগ সময়ই জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া এবং শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা তাঁদের দিক থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করার লড়াইয়ে লিপ্ত থেকেছেন। কে শাসন করার অধিকার রাখেন সেই লড়াইয়ে দেশটি আটকে আছে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আসলে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল আমার সংগ্রাম।’
২০১৮ সালে খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে জেলে গিয়েছিলেন। স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় তিনি এখন টেলিভিশন দেখা এবং সংবাদপত্র পড়াও কমিয়ে দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানকে ২০০৪ সালে একটি সমাবেশে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে এক ডজন গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে তারেক লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে কার্যত দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর বিরুদ্ধেও ৯৩টি মামলা রয়েছে।
কোভিড মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত পোশাক শিল্পকে স্বরূপে ফিরিয়ে আনতে যখন চেষ্টা করছিল বাংলাদেশ, ঠিক তখন ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন আমদানি করা জ্বালানি এবং খাদ্যের দাম বাড়ায় দেশের ডলার সরবরাহকে বিপজ্জনকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটি আমাদের অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে।’
গত জুনে একটি সমাবেশে বিএনপির বক্তারা অবাধ নির্বাচন ও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবি জানান। দলটির সমর্থকেরা ‘হাসিনার সিংহাসন জ্বালিয়ে দাও’ এবং ‘রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’—এসব উত্তেজক স্লোগানে মুখরিত করেন।
প্রথমে পুলিশ বাধা দিলেও পরে বিরোধীদের সমাবেশ ও মিছিলকে অনুমতি দেওয়া হয়। বিপরীতে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও একটি পাল্টা সমাবেশ করেন। এই সমাবেশে বক্তারা স্বীকার করেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্রে নজর রাখছে।
মার্কিন সরকার শেখ হাসিনার কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে। এ ছাড়া আমেরিকান ও ইউরোপীয় কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সফরও করেছেন।
বিএনপির মহাসমাবেশের কয়েক সপ্তাহ পরেই শেখ হাসিনা বিরোধীদের ওপর আবার কঠোরতা প্রদর্শন করেন। বিরোধী দলগুলোর সমর্থকেরা আবার একটি বড় সমাবেশ করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করেছে। নতুন করে ৫০০ মামলা দেওয়া হয়।
বিরোধীদের ওপর আবার সরকারের এই কঠোর মনোভাবই প্রমাণ করে, পশ্চিমা সতর্কতা শেখ হাসিনার ওপর খুব কমই প্রভাব ফেলতে পেরেছে। তিনি এশিয়ার দুই পরাশক্তি চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখেছেন।
প্রতিবেদনটির লেখক মুজিব মেশাল, নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো চিফ