দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টুইন টাওয়ারে হামলার (নাইন-ইলেভেন হামলা) ২২ বছর পূর্তি আজ। এটি ছিল শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ একটি হামলা। ২০০১ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রে চারটি যাত্রীবাহী প্লেন ছিনতাই করে সেগুলো দিয়ে আঘাত হানা হয় নিউইয়র্কের দু’টি আকাশচুম্বী ভবনসহ মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনে। এসব হামলার ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। এ হামলার ঘটনার ভয়াবহতায় কেবল মার্কিন নাগরিকরাই নয়, চমকে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ছিল মঙ্গলবার। ছিনতাইকারীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে পূর্ব আমেরিকার আকাশপথে উড্ডয়নরত চারটি প্লেন একইসাথে ছিনতাই করে। তারপর নিউইয়র্ক আর ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ ভবনে আঘাত হানার জন্য বিশাল ও নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র হিসাবে বিমানগুলোকে তারা ব্যবহার করে।

দু’টি বিমান দিয়ে হামলার পর বিধ্বস্ত করানো হয় নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ভবনে। প্রথম প্লেনটি আঘাত হানে নর্থ টাওয়ারে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় সময় সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে। এর কিছু সময় পর সকাল ৯টা ৩ মিনিটে দ্বিতীয় প্লেনটি সাউথ টাওয়ারে বিধ্বস্ত করা হয়।

হামলার পর দু’টি ভবনেই আগুন ধরে যায়। ভবন দু’টির ওপরতলায় বহু মানুষ আটকা পড়েন। শহরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। সুউচ্চ এই দু’টি টাওয়ার ভবনই ছিল ১১০ তলা করে। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে দু’টি ভবনই বিশাল ধুলার ঝড় তুলে মাটিতে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ে।

অন্যদিকে তৃতীয় প্লেনটি পেন্টাগনের সদর দপ্তরের পশ্চিম অংশে আঘাত হানে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির উপকণ্ঠে ছিল মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের বিশাল এই সদর দপ্তর পেন্টাগন ভবন।

এরপর, সকাল ১০টা ৩ মিনিটে চতুর্থ প্লেনটি আছড়ে পড়ে পেনসিলভেনিয়ার একটি মাঠে। ছিনতাই হওয়া চতুর্থ প্লেনটির যাত্রীরা ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পর সেটি পেনসিলভেনিয়ায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ধারণা করা হয়- ছিনতাইকারীরা চতুর্থ প্লেনটি দিয়ে মার্কিন গণতন্ত্রের প্রতীক ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে আঘাত হানতে চেয়েছিল।

ভয়াবহ এসব হামলায় সব মিলিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ২ হাজার ৯৭৭ জন। তবে এই হিসাবের মধ্যে ১৯ জন ছিনতাইকারী নাম অন্তর্ভুক্ত নেই। নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন নিউইয়র্কের মানুষ। চারটি প্লেনের ২৪৬ জন যাত্রী এবং ক্রুদের প্রত্যেকেই নিহত হন। টুইন টাওয়ারের দু’টি ভবনে মারা যান ২ হাজার ৬০৬ জন। পেন্টাগনের হামলায় প্রাণ হারান ১২৫ জন।

নাইন ইলেভেনের সেই ভয়াবহ হামলায় সর্বকনিষ্ঠ নিহতের বয়স ছিল দুই বছর। তার নাম ক্রিস্টিন লি হ্যানসন। বাবা-মায়ের সাথে সে একটি বিমানের যাত্রী ছিল। নিহত সবচেয়ে বেশি বয়সী ব্যক্তির নাম রবার্ট নর্টন। তার বয়স ছিল ৮২ বছর। তিনি ছিলেন অন্য আরেকটি বিমানের আরোহী এবং নিজের স্ত্রী জ্যাকুলিনের সাথে তিনি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন।

হামলার দিন প্রথম প্লেনটি যখন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত করে, তখন ভেতরে আনুমানিক ১৭ হাজার ৪০০ জন মানুষ অবস্থান করছিলেন। নর্থ টাওয়ারের যে অংশে বিমান আঘাত করে, তার ওপরের কোনো তলার মানুষই প্রাণে বাঁচেননি। তবে সাউথ টাওয়ারে যেখানে বিমান আঘাত করে, তার ওপরের অংশ থেকে ১৮ জন প্রাণে বেঁচে যান।

হতাহতের মধ্যে ৭৭টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ ছিলেন। নিউইয়র্ক শহরে যারা প্রথম ঘটনাস্থলে জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় দৌঁড়ে যান, তাদের মধ্যে মারা যান ৪৪১ জন। হামলায় হাজার হাজার মানুষ আহত হন, যারা পরে নানা ধরনের অসুস্থতার শিকার হন। যেমন দমকলকর্মীদের অনেকে বিষাক্ত বর্জ্যের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

৯/১১ নামে পরিচিতি পাওয়া ওই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ শামিল হয় পশ্চিমা দুনিয়া। ওই হামলার জন্য আল কায়েদাকে দায়ী করে দলটির নেতা ওসামা বিন লাদেনের ঘাঁটি আফগানিস্তানে হামলা চালায় ওয়াশিংটন। ক্ষমতাচ্যুত করা হয় লাদেনের মিত্র তৎকালীন তালেবান সরকারকে। তবে গত ২২ বছরে পরিবর্তন এসেছে সেই দৃশ্যপটেও। ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার দুই দশকের মাথায় আফগানিস্তান ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্র। ফের কাবুলের কুরসি ছিনিয়ে নেয় তালেবান।

নিহতদের স্মরণে ৯/১১ স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘরে বার্ষিক আয়োজন ‘আলোতে শ্রদ্ধাঞ্জলি’র পাশাপাশি নিউ ইয়র্ক সিটির আশেপাশে কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধে স্থানীয় সময় সোমবার সকাল সাড়ে আটটায় অনুষ্ঠান শুরু হবে। শেষ হবে দুপুর একটার দিকে। প্রতি বছর এই আয়োজনে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নিহতদের নাম পাঠ এবং ছয় বার নীরবতা পালন করা হয়। জাদুঘরটি সারা দিন জনসাধারণের জন্য বন্ধ থাকবে, শুধু নিহতদের পরিবারের সদস্য ও সংরক্ষিত টিকিটধারীদের জন্য খোলা থাকবে। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক পোস্টের খবর অনুসারে, এবার হামলায় নিহতদের স্মরণে নিউ ইয়র্কের গ্রাউন্ড জিরো, পেনসিলভানিয়ার শ্যাঙ্কসভিলে ও ভার্জিনিয়ার আর্লিংটনের পেন্টাগনে সশরীরে উপস্থিত থাকছেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি দিনটি অতিবাহিত করবেন আলাস্কায়।

নিউ ইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামস বলেছেন, হামলায় নিহতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬৪৯ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এক বিবৃতিতে শুক্রবার তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ এক নারী ও এক পুরুষের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। এটা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিতে পারে।’

এখনও অবশ্য ১ হাজার ১০৪ জনের পরিচয় মেলেনি। তাদের শনাক্তকরণের অগ্রগতিও মন্থর। সর্বশেষ শনাক্তকরণ হয়েছিল ২০২১ সালে।

সর্বশেষ নিহত দুইজনের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে অত্যাধুনিক সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তির কল্যাণে। এটি ডিএনএ পরীক্ষার চেয়ে বেশি সংবেদনশীল ও দ্রুত। নিহতদের পরিবারের অনুরোধে তাদের পরিচয় প্রকাশ হয়নি।

ছিনতাইকারী ছিল মোট ১৯ জন। তাদের মধ্যে তিনটি দলে ছিল পাঁচজন করে এবং তারা টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে বিমান হামলা চালায়। আর যে বিমানটি পেনসিলভেনিয়ায় বিধ্বস্ত হয়, তাতে ছিনতাইকারী দলে ছিল চারজন।

প্রত্যেক দলে একজন ছিনতাইকারীর বিমানচালক হিসাবে প্রশিক্ষণ ছিল। এই ছিনতাইকারীরা তাদের পাইলটের ট্রেনিং নেন খোদ যুক্তরাষ্ট্রেরই ফ্লাইং স্কুলে। ১৫ জন ছিনতাইকারী ছিলেন সউদী আরবের। দু’জন সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) এবং মিসর ও লেবাননের ছিলেন একজন করে।