আমির হামজা, দ্য রিপোর্ট: বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অধিকার ও তাদের মান উন্নয়ন নিয়ে সম্প্রতি একটি নতুন স্মারকপত্রে (প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরেন্ডাম) স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যেখানে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে যারা শ্রমিক অধিকার হরণ করবে, শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখাবে এবং আক্রমণ করবে তাদের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেবে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য বড় সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা। তাই যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের করণীয় নির্ধারণে শিগগির আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বসবে পররাষ্ট্র, শ্রম, বাণিজ্য, আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত বৃহস্পতিবার এ ধরনের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।। তার পর অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিনক্ষণ ঠিক করে চলতি সপ্তাহেই আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হতে পারে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারাবিশ্বের জন্য শ্রম ইস্যূতে কথা বলেছেন। দেশটি এখনো ব্যবসা–বাণিজ্য নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানায়নি। এ বিষয়ে যদি কোনো সিদ্ধান্ত আসে তখন বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের শ্রমিক সহিংসতার কথা বলছে সে ধরনের পরিস্থিতি বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। ২০১১ সালে রানাপ্লাজা ভেঙ্গে যাওয়ার সময় দেশে মাত্র ৩০০ ট্রেড ইউনিয়ন ছিল, এখন তা বেড়ে প্রায় ১ হাজার ২০০। এখন অনেক কম শ্রমিক দিয়ে একটি সংগঠন করা যায় এছাড়া গত দশ বছরে তিনবার শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতি শ্রম অধিকার ইস্যূতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। তবে রাজনৈতিক কারণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে সেটা ভিন্ন বিষয়।

শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মজুরি খসড়া গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। যদি আরও বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছে শ্রমিকরা, খসড়া প্রকাশের ১৪ দিনের মধ্যে তা পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। শ্রমিকদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শ্রমিক অধিকার সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী চাইলে খসড়া থেকে কিছু বেতন বাড়িয়ে দিতে পারেন। সারাবিশ্বের জন্য শ্রমনীতি ঘোষণা করা হলেও সেখানে উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের এক শ্রমিক অধিকার কর্মীর কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটিও উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তপন কান্তি ঘোষ বলেন, আমরা নিজেদের স্বার্থের শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছি। এমন পরিস্থিতিতে কোনো দেশের মন্ত্রী একটা কথা বলেছে বলে অস্থির হয়ে গেছি এমনটি নয়। সরকার ইতোমধ্যে শ্রম আইন সংশোধনসহ শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহী বলেন, শ্রমিক অধিকার রক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে নেওয়া সরকারের কর্মপরিকল্পনা এবং আইএলওএর রোডম্যাপ অনুযায়ী গত আড়াই বছরে প্রায় ৯০ শতাংশ অর্জন হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রধান প্রতি সপ্তাহে শ্রম মন্ত্রণালয়ে আসেন। এমন কোনো সমস্যা নেই যার সমাধান করা হয়নি। কল্পনার আক্তার নামের একজন শ্রমিক অধিকারকর্মীর জীবন রক্ষায় পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অথচ কল্পনা আক্তার কোনো দিন শ্রম মন্ত্রণালয় বা এর আওতাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনোর ধরনের কোনো অসুবিধার কথা জানাননি।তিনি বলেল, শ্রমিক ইস্যুতে আইএলওতে সম্প্রতি গভার্নিং বডির মিটিং করে আসলাম। তারপর টিকফা ও ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকেও বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নেওয়া কার্যক্রমের অগ্রগতি জানানো হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তাদেও চাওয়া অনুযায়ী পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তারপরও ২০১৩ সালের পর থেকে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তবে তারা আরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইএলও–এর পরামর্শ মেনে চলার তাগিদ দিয়েছে। বাংলাদেশে জানিয়েছে আগামী এগুলোও বাস্তবায়ন করা হবে।

তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে যেসব শ্রমিক নেতার মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন ছিলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় সেগুলোর বিচার কার্যক্রম চলছে। এতকিছু অগ্রগতির পরও যুক্তরাষ্ট্র স্টেটমেন্ট দিয়েছে। অসুবিধা নেই দিতেই পারে। এখন এর প্রক্ষিতে বাংলাদেশ পদক্ষেপ কি হবে তা পররাষ্ট্র, আইন, বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমনকি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এহছানে এলাহী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঘোষণার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে তারা বৈঠক করবেন। শ্রমিক অধিকারের আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলো আইন মন্ত্রণালয় দেখে থাকে। প্রয়োজনে আইনমন্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করা হবে। একই সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গেও আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার বাইডেন এ সংক্রান্ত মেমোরেন্ডামে স্বাক্ষর করার পরে সানফ্রান্সিসকোর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে এর বিস্তারিত তুলে ধরেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিঙ্কেন।তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের অধিকার এবং তাদের শ্রম মান উন্নয়নের জন্য কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির কেন্দ্রীয় অংশ এবং এটি পররাষ্ট্র দপ্তরেরও কার্যক্রমের মূল বিষয়।’শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যারা শ্রমিকদের হুমকি-ধামকি দেবে, ভয় দেখাবে, শ্রম ইউনিয়নের নেতা, শ্রম অধিকারের পক্ষে কাজ করা ব্যক্তি এবং শ্রম সংগঠনের ওপর আক্রমণ করবে, তাদের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।’

এ সময় ব্লিংকেন বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার কর্মী কল্পনা আক্তারের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা কল্পনা আক্তারের মতো মানুষদের পাশে থাকতে চাই, যিনি বলেন যে তিনি এখনো জীবিত আছেন কারণ আমেরিকার দূতাবাস তার পক্ষে কাজ করেছে।’তিনি আরও বলেন, ‘শ্রম অধিকার আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা এবং বৈদেশিক নীতির চাবিকাঠি। এটা শুধুই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এটা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতির বিষয়।’