আমির হামজা, দ্য রিপোর্ট: রাষ্ট্রীয় জ্বালানি সংস্থা পেট্রোবাংলা আন্তর্জাতিক ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) থেকে উচ্চ সুদে ৫০০ মিলিয়ান মার্কিন ডলার ঋণ নিতে চলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের মধ্যে বিশাল এলএনজি-আমদানি বিলগুলি মিটানোর জন্য সরকার এর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে । 

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পেট্রোবাংলা কর্তৃক তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি নির্বিঘ্নে ও গ্যাসের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে এলএনজি আমদানি অর্থায়নে আই টি এফসি হতে মা ড. ৫০০ মিলিয়ন ঋণ সহায়তা গ্রহণের বিষয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সমন্বয়ে আলোচনা সভা হয়েছে বুধবার ১৫ নভেম্বর অর্থনৈতিক সর্ম্পক বিভাগের এশিয়া অনুবিভাগের সম্বেলন কক্ষে। সভায় সভাপতিত্বে করেন অর্থনৈতিক সর্ম্পক বিভাগের শরিফা খান। আইটিএফসি থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়টি কমিটি সম্মত হয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবটি প্রধান মন্ত্রী কাছে পাঠানো হয়েছে । পেট্রোবাংলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে নিরবচ্ছিন্ন এলএনজি আমদানির জন্য অন্তত আগামী ছয় মাসের জন্য পথ পরিশোধ করতে আইএসডিবি গ্রুপের সদস্য আইটিএফসি-এর সাথে এটি ইতিমধ্যেই আলোচনা হয়েছে।

অনুমোদিত হলে, এটি প্রথমবারের মতো আইটিএফসি থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল, গ্যাস ও খনিজ কর্পোরেশনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হবে।কর্পোরেশনটি মার্কিন ডলারের ঋণের দিকে নজর দেয় কারণ এটি বিশ্বব্যাপী এলএনজি সরবরাহকারী - দীর্ঘমেয়াদী এবং স্পট সরবরাহকারী উভয়ই - এবং আন্তর্জাতিক তেল সংস্থাগুলি (আইওসি) কে চলমান ডলার সংকটের পরে অর্থপ্রদানের বকেয়া নিষ্পত্তি করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে৷

তরল গ্যাস আমদানিতে এর আগে গ্যাস ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (জিডিএফ) থেকে প্রায় ২০ বিলিয়ান টাকার অর্থ ব্যয় করেছে, যা বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে সীমিত প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদনের কারণে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের জন্য তহবিল সহায়তা প্রদানের জন্য তৈরি করা হয়েছিল -- সম্ভাব্য উপকূলীয় ক্ষেত্র এবং বঙ্গোপসাগরের প্রায় ভার্জিন টার্ফগুলিতে।পেট্রোবাংলার কর্মকর্তা আইটিএফসি ঋণের সুদের হার সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি তবে বলেছিলেন যে এটি সুরক্ষিত ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট ( এসও এফ আর) প্লাস ২ দশমিক ০ শতাংশের কাছাকাছি হবে, বর্তমানে এসওএফআর হার ৫ দশমিক ০৬ শতাংশের কাছাকাছি থাকায় মোট ৭ দশমিক ০৬ শতাংশ।

১ জুলাই থেকে, এসও এফআর আন্তর্জাতিক ঋণের জন্য নতুন বেঞ্চমার্ক-সুদের হার হিসাবে লন্ডন ইন্টারব্যাঙ্ক অফারড রেট(লাইবর) প্রতিস্থাপন করেছে।কর্মকর্তারা বলছেন যে এলএনজি সরবরাহকারী এবং আইওসি দীর্ঘদিন ধরে সরবরাহ বন্ধের পূর্ব সতর্কতার সাথে ফেরত পরিশোধের জন্য চাপ দিয়ে আসছে।এলএনজি ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়া কতটা বিপজ্জনক তা বহুল আলোচিত। গত ৫ বছরে দেশে শুধু এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। যদিও এ সময়ে দেশের পুরো গ্যাস ক্রয় বাবদ ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। মোট গ্যাসের ২৪ শতাংশ পাওয়া গেছে এলএনজি থেকে। অথচ ব্যয় করতে হয়েছে ৭৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ গ্যাসের সমান দাম। আগামী দিনে আরও তিনগুণ এলএনজি আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২৬ সালের পর এলএনজি আমদানি ১০ দশমিক ৫০ মিলিয়ন টন পার ইয়ার (এমটিপিএ) ছাড়ানোর ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ আমদানির জন্য প্রথমবারের মতো আইটিএফসি থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার চুক্তি হয়েছে। যেহেতু এলএনজির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়া বিপজ্জনক, সেহেতু এলএনজি আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে।

দেশে গ্যাস সরবরাহের বেশিরভাগই আসে স্থানীয়ভাবে উত্তোলনের মাধ্যমে। এর মধ্যে শেভরন উত্তোলন করছে মোট গ্যাসের ৫০ শতাংশ, আর স্থানীয় কোম্পানিগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে ২৬ শতাংশ। শেভরনের গ্যাস ক্রয়ে বছরে ব্যয় ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ অর্থ; স্থানীয় কোম্পানিগুলোর পেছনে বছরে ব্যয় হয় ৫ শতাংশের কিছু বেশি। এ অবস্থায় ব্যয়বহুল এলএনজি নিয়ে অতিরিক্ত তৎপরতা কতটা বাস্তবসম্মত তা আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। ইতোমধ্যে কাতার এনার্জি কোম্পানি থেকে প্রতিবছর অতিরিক্ত ২৪ কার্গো এলএনজি আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। আগামী ১৫ বছর এ কোম্পানি থেকে এলএনজি কিনবে সরকার। এছাড়া ওকিউ ট্রেডিং লিমিটেড থেকেও আগামী ১০ বছর মেয়াদি প্রতিবছর দেড় এমটিপিএ গ্যাস বাড়ানোর চুক্তি করা হয়েছে। এ চুক্তির আওতায় ২০২৬ সালে প্রথম বছরে চারটি এলএনজি কার্গো, ২০২৭ ও ২০২৮ সালে প্রতিবছর ১৬টি এলএনজি কার্গো এবং ২০২৯ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ২৪টি কার্গো সরবরাহ করবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে জ্বালানি বিভাগ; নতুন করে আরও বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে আর্থিক ঝুঁকিতে পড়েছে জ্বালানি খাত। তারা বলেন, গত কয়েক দশকে স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা হলে এলএনজির ওপর এতটা নির্ভর করতে হতো না। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যে পরিমাণ অর্থ আমদানিতে ব্যয় করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা দেশে বিনিয়োগ করা হলে দুই বছরের মধ্যে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব। তারা বলেন, এলএনজি-নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা না গেলে সামনের দিনগুলোয় বিপদ আরও বাড়তে পারে।এলএনজি আমদানির পাশাপাশি সরকার দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলনের নানা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে মোট ৪৬টি কূপ খনন, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করা হবে। এজন্য সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও ডিপিপি প্রণয়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে মনিটরিং ও নির্দিষ্ট সময় পরপর সমন্বয় সভা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯টি কূপ খনন, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্বের যে কোনো দেশের কোম্পানির তুলনায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেস্ক) গড় সাফল্য বেশি। বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।