দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মোট মজুরি ৫২-৫৬ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হলেও, বাস্তবে বৃদ্ধির হার ২৫-২৮.৮৮ শতাংশ মন্তব্য করে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের কাছে নিজেদের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

নিম্নতম মজুরি বোর্ড চেয়ারম্যানকে পাঠানো চিঠি ও বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিনিময় মূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় পোশাকশ্রমিকদের মজুরি প্রকৃত অর্থে ৩০ শতাংশও বাড়েনি।

পোশাকশ্রমিকদের জীবনমান, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবিত নিম্নতম মজুরি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।

মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় এই আহ্বান জানায় সংস্থাটি।

নিম্নতম মজুরি বোর্ডকে পাঠানো চিঠিতে টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর প্রকাশিত নিম্নতম মজুরি কাঠামো অনুযায়ী প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে মূল মজুরি বৃদ্ধির নির্দেশনা রয়েছে। সে হিসেবে পূর্ববর্তী গ্রেড সাত বা নতুন প্রস্তাবিত গ্রেড পাঁচে ২০২৩ সালে মূল মজুরি ন্যূনতম ৫২৩২.৭৫ টাকা হওয়ার কথা। এই গ্রেডে প্রস্তাবিত নতুন মূল মজুরি ধরা হয়েছে ৬৭০০ টাকা। অর্থাৎ এই গ্রেডে মূল মজুরি ৬৩% বাড়ানো হয়েছে বলা হলেও, তা প্রকৃতপক্ষে বেড়েছে ২৮.০৪%। গ্রেড চারের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার ২৬.৫২%। একইভাবে, গ্রেড তিন, দুই ও এক-এর ক্ষেত্রে মূল মজুরি প্রকৃত বৃদ্ধি পাবে ২৪.১৬%, ২৩.৯৭% এবং ২৪.৭১%। প্রতিবছর মূল মজুরি ৫% হারে বাড়লে ২০২৩ সালে এসে নতুন প্রস্তাবিত গ্রেড পাঁচে ন্যূনতম মোট মজুরি হওয়ার কথা ৯৬৯৯.১৩ টাকা। নতুন প্রস্তাবিত মজুরি কাঠামো অনুযায়ী এই গ্রেডে সর্বমোট মজুরি প্রস্তাব করা হয়েছে ১২৫০০ টাকা। অর্থাৎ, ৫৬ শতাংশ সর্বমোট মজুরি বাড়ানো হয়েছে বলা হলেও, তা প্রকৃত বিচারে বেড়েছে মাত্র ২৮.৮৮%। একইভাবে গ্রেড চার, তিন, দুই ও এক এর ক্ষেত্রে মোট মজুরি বৃদ্ধির হার যথাক্রমে মাত্র ২৭.৫৯%, ২৫.৫৮%, ২৫.৩৫% এবং ২৫.৯৩%।

আবার মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনায় মূল মজুরি বৃদ্ধির প্রকৃত হার আরও কম। মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করা হলে পঞ্চম গ্রেডে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মূল মজুরি হওয়ার কথা ৫৫৭২.২৬ টাকা, যেখানে নতুন প্রস্তাবিত মূল মজুরি ৬৭০০ টাকা। অর্থাৎ, মূল মজুরি ৬৩% বাড়ানো হচ্ছে বলা হলেও তা মূলত বাড়ছে ২০.২৪%। একইভাবে গ্রেড চার, তিন, দুই ও এক-এ মূল মজুরি বৃদ্ধির প্রকৃত হার দাঁড়ায় ১৮.৮১%, ১৬.৫৯%, ১৬.৪১% এবং ১৭.১১%। সর্বমোট মজুরির হিসাবে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে গ্রেড পাঁচে ২০২৩ সালে একজন শ্রমিকের ৯৯১৩.৫০ টাকা পাওয়ার কথা। সর্বমোট মজুরি এই গ্রেডে ৫৬% বাড়িয়ে ১২৫০০ টাকা করা হয়েছে বলা হলেও, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে সর্বমোট মজুরি বৃদ্ধির হার মাত্র ২৬.০৯%। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় গ্রেড চার, তিন, দুই ও এক-এ প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার ২৪.৮০%, ২২.৮০%, ২২.৫৫% এবং ২৩.১০%।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মূল মজুরি সর্বমোট মজুরির ৬০ শতাংশ ধরা হলেও, বাংলাদেশের প্রস্তাবিত মজুরি কাঠামো অনুযায়ী তা ৫৩ থেকে ৫৬ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে বছর প্রতি ৫% মূল মজুরি বৃদ্ধির সুযোগ রাখা হলেও, সামনের দিনে তুলনামূলক কম মজুরি বাড়বে শ্রমিকদের। যা এই মজুরি কাঠামোর বড় দুর্বলতা।

এমন সব বাস্তবতায় শ্রমিকদের মজুরি ৫৩-৫৬% বাড়ানো হয়েছে—এমন হিসেবকে শুভংকরের ফাঁকি উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন গবেষণা ও বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামগ্রিক বিবেচনায় পোশাকশ্রমিকদের নতুন প্রস্তাবিত ন্যূনতম মজুরি জীবনধারণের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকর্তৃক নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রমিক ও তার পরিবারের প্রয়োজন, দেশের সাধারণ মজুরি কাঠামো, জীবনযাপনের ব্যয় এবং এ সংক্রান্ত পরিবর্তন, সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা, অন্যান্য সংশ্লিষ্ট শ্রমজীবিদের জীবনযাত্রার মান এবং অর্থনৈতিক বিবেচ্য, বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা এবং উচ্চ কর্মসংস্থান তৈরির বিষয়সমূহ মাথায় রাখার কথা বলা হয়েছে। নতুন মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনগুলো কী আকারে বিবেচনা করা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। বরং শ্রমিকের ন্যূনতম জীবনমান ও প্রয়োজন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে জীবনযাপন ব্যয় ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়সমূহ মোটেই গুরুত্ব পায়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ’

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনরত পোশাকশ্রমিকদের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে চার শ্রমিকের জীবনহানির ঘটনাকে চরম দুঃখজনক উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, ‘পৃথিবীর দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ, সেখানে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় যৌক্তিক মজুরি না দেওয়াটা সত্যিই লজ্জাজনক। একইভাবে বিব্রতকর বিষয় হচ্ছে, তৈরি পোশাক রপ্তানির বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে কম মজুরি দিয়ে আসছে। নতুন ঘোষিত কাঠামো অনুযায়ীও বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের মজুরির তুলনামূলক সর্বনিম্ন অবস্থান অব্যাহত থাকবে। একইসঙ্গে, টাকার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার অভূতপূর্ব দরবৃদ্ধির ফলে শিল্পমালিকেরা ক্রমবর্ধমান মুনাফার মূল চালিকাশক্তি শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি অগ্রাহ্য করে মালিকপক্ষ তাদের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার খোড়া যুক্তি অব্যাহত রেখেছেন। এমন বাস্তবতায় শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিতে মানসম্মত মজুরি প্রদানের জন্য মজুরি কাঠামোসংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে, উল্লিখিত মানদণ্ডসমূহের আলোকে শ্রমিকদের প্রত্যাশা এবং দাবি ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য টিআইবি বিশেষভাবে সুপারিশ করেছে। ’