হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন
বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে সহিংস স্বৈরাচারী অভিযান
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বিরোধী দলীয় নেতা ও সমর্থকদের টার্গেট করছে। কর্তৃপক্ষের উচিত সহিংসতার সমস্ত ঘটনা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা। এমনকি উভয় পক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করেছে- এমন মামলাও তদন্ত করা উচিত।
গত ২৮ অক্টোবর প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সমাবেশের পর থেকে প্রায় ১০ হাজার বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চলমান সহিংসতায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জ্যেষ্ঠ এশিয়াবিষয়ক গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, সরকার একদিকে কূটনৈতিক অংশীদারদের নিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের কারাগারে ভরা হচ্ছে। কূটনৈতিক অংশীদারদের স্পষ্ট করে বলা উচিত যে, সরকারের স্বৈরাচারী দমন-পীড়ন ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে বিপন্ন করবে।
১৩ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার, ভিডিও ও পুলিশের প্রতিবেদন বিশ্লেষণের ভিত্তিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রমাণ পেয়েছে যে, সাম্প্রতিক নির্বাচন-সম্পর্কিত সহিংসতায় নিরাপত্তা বাহিনী অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ, নির্বিচারে গণগ্রেপ্তার, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী।
২৮ অক্টোবরের সহিংসতার পর বিএনপি ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এ সময় পুলিশ, বিরোধী দলীয় সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। যদিও চারদিকে সহিংসতা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়া জানাতে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করেছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বিরোধী দলকে 'বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির' দায়ে অভিযুক্ত করেছে এবং এটিকে 'অপরাধস্থল' (ক্রাইম সিন) হিসেবে আখ্যায়িত করে বিএনপির দলীয় কার্যালয়গুলো সিলগালা করে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলাকে উৎসাহিত করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে চলমান সহিংসতাকে উস্কে দিয়েছেন। গত ৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা জানান, 'তারা যদি কাউকে আগুন ধরিয়ে দেয়, তাহলে তাদের একই আগুনে নিক্ষেপ করতে হবে। যে হাত আগুন ধরিয়ে দেয়, সেই হাত পুড়িয়ে ফেলতে হবে...।
ভিডিও ও প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হুমকি ও টার্গেট করার ক্ষেত্রে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে সমন্বয়ের বিরক্তিকর প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিএনপির এক সমর্থক বলেন, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাস্তায় থাকায় মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে।
গত ৪ নভেম্বর ঢাকায় এক সাংবাদিকের ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কাঠের লাঠি হাতে পুলিশের পেছনে লাঠি নিয়ে মিছিল করছে। একই ধরনের দৃশ্য ধরা পড়েছে দেশের অন্যান্য অংশেও। গত ৪ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে ফেনী জেলার একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সমর্থকরা কাঠের লাঠি হাতে পুলিশের সঙ্গে মিছিল করছে।
গত ৫ নভেম্বর ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা একটি গাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপের পর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একত্রিত হয়ে জড়িতদের খোঁজে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার ভিডিও ও ছবি থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগের কর্মী ধাতব রড হাতে সশস্ত্র ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, 'রাস্তায় থাকা লোকজন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার বা আওয়ামী লীগের মারধরের ভয়ে ভীত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, পুলিশের উচিত সব পক্ষের সহিংসতার ঘটনার তদন্ত করা, কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালালে তাদের নিরপেক্ষতা ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার সক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হয়। চলমান সহিংসতায় আওয়ামী লীগের কর্মীরা দায়মুক্তি ভোগ করলেও বিরোধী দলীয় সদস্যরা ব্যাপকভাবে এবং প্রায়ই নির্বিচারে গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হচ্ছেন।
বাংলাদেশ সরকার সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলকে উৎখাত করতে এবং প্রতিযোগিতা নির্মূল করার সুস্পষ্ট প্রয়াসে রাজনৈতিক বিরোধীদের গণগ্রেপ্তার করছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মতে, এর ৫০ লাখ সদস্যের প্রায় অর্ধেক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারের সম্মুখীন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে এক অ্যাক্টিভিস্ট বলেন, 'তারা সিনিয়র পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত কাউকে ছাড়ছে না।'
আরেকটি বিরোধী দল এবি পার্টির একজন মুখপাত্র হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, তাদের অনেক সমর্থক রাতে পুলিশের অভিযানের কারণে আত্মগোপনে রয়েছেন। নজিরবিহীন মাত্রার ভিড়ের কারণে কারাগারের পরিস্থিতি অসহনীয়। বাংলাদেশের কারাগারগুলো বর্তমানে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কারাগারে ৪২ হাজার বন্দী থাকলেও আমরা ৯০ হাজার বন্দি রাখতে পারি। সুতরাং আমাদের পিআর-এর সক্ষমতা বাড়ানোর দরকার নেই।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে কয়েকজনকে হেফাজতে মারধর ও নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একজন নারী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, তার ভাইকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, 'আমি লক্ষ্য করেছি তার বাম হাতের একটি আঙ্গুল ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।' বিএনপির এক কর্মী জানান, গত ৩০ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত ভাইকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। ১০ দিন ধরে আটক করে রাখে। স্বাস্থ্যগত উদ্বেগের কথা বলা সত্ত্বেও তাকে হেফাজতে রেখে মারধর করা হয়।
বিদেশি সরকারগুলোর জোর দেওয়া উচিত যে, কর্তৃপক্ষ মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে তাদের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা যেন বজায় রাখে। বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের 'এভরিথিং বাট আর্মস' বাণিজ্য কর্মসূচির প্রধান সুবিধাভোগী এবং বাংলাদেশ সরকার 'জেনারেলাইজড স্কিম অফ প্রেফারেন্সেস +' ব্যবস্থার জন্য আবেদন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, যা গার্মেন্টসসহ মূল রফতানির উপর বাণিজ্য শুল্ক হ্রাস করবে। সরকারের অপব্যবহার উভয় প্রোগ্রামের জন্য তার যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দুটি বিষয়ই নির্দিষ্ট মানবাধিকার এবং শ্রম অধিকারের মানদণ্ডের উপর শর্তযুক্ত। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যেমনটি ইইউ কর্মকর্তারা দেশটিতে সাম্প্রতিক সফরে করেছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জ্যেষ্ঠ এশিয়াবিষয়ক গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলছেন, সরকার যখন মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করে এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তার, গুম, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিরোধী দল, সমালোচক ও কর্মীদের পরিকল্পিতভাবে অক্ষম করে- তখন একটি অবাধ নির্বাচন অসম্ভব। তিনি বলেন, 'সহিংসতা উস্কে দিয়ে সমালোচকদের কারাগারে পাঠানোর পরিবর্তে শেখ হাসিনার উচিত অবিলম্বে নির্বিচারে রাজনৈতিক গ্রেপ্তার বন্ধের আহ্বান জানানো এবং স্পষ্ট করে বলা যে, নিরাপত্তা বাহিনীর গুম, নির্যাতন ও হত্যা সহ্য করা হবে না।