দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩২টি আসনে শরিকদের ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি (জাপা) ছাড় পেয়েছে ২৬ আসনে; ১৪ দলীয় জোটকে দেওয়া হয়েছে ছয়টিতে।

এসব আসনের বেশিরভাগে সরাসরি আবার স্বতন্ত্র হিসেবে আছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তাই নির্বাচনে বেশ চাপেই থাকতে হচ্ছে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলকে।

একাদশ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি কয়েকটি আসনে নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছে। কিন্তু আগামী নির্বাচন দিয়ে দলটির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। জাপা সদস্য মুখে বিভাজনের কথা অস্বীকার করলেও দলের কার্যক্রমে বিষয়টি মোটা দাগে দেখা যায়। এর মধ্যে পার্টির পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের অনুসারী হওয়ায় সরাসরি দল থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হন সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা ও রুস্তম আলী ফরাজী। তারা আগামী নির্বাচনে লড়তে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ বিভাজনের কারণে সুযোগ বাড়ছে অন্যান্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদের ঢাকা-১৮ আসন থেকে নির্বাচন করছেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের সরাসরি কোনো প্রার্থী নেই। তবে কেটলি প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক মো. খসরু চৌধুরী। ফলে চাপে পড়েছেন শেরিফা। কেননা, দুই যুগের বেশি সময় ধরে ঢাকা-১৮ আসনের মানুষের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন খসরু চৌধুরী। জনপ্রতিনিধি না হয়েও ঢাকা-১৮ আসনের অনেক কাঁচা রাস্তা পাকাকরণ, সংস্কার ও চলাচল উপযোগী করেছেন। ঢাকা-১৮ আসনে মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন দরিদ্র মানুষদের শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজধানীর দক্ষিণখান ও উত্তরখানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেছেন খসরু চৌধুরী। ফলে প্রথমবার ভোট করে শেরিফা কাদেরের জয় নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

কয়েকটি আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের বিপক্ষে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীও আছেন চারজন। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ মুখে পড়তে হবে আরও ৮ আসনে। নির্বাচনে তাদের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।

জাপার সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা রংপুর-১ আসনে লড়ছেন। এ আসনে জাপা প্রার্থী দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন গঙ্গাচড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবুল। দলীয় কোন্দলের কারণে এ আসনে হার বরণ করতে হতে পারে জাপার প্রার্থীকে।

পিরোজপুর-৩ আসনে বারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য রওশনপন্থী রুস্তম আলী ফরাজী মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া এ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মাশরেকুল আজম। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুর রহমানের বড় ভাই শামীম শাহনেওয়াজ। দৃশ্যমান দলীয় কোন্দলের কারণে আসনটি হাতছাড়া হতে পারে জাপার।

নীলফামারী-৩ আসনে জাতীয় পার্টি রয়েছে বিপাকে। আসনে জাপার সরাসরি প্রার্থী রানা মোহাম্মদ সোহেল। তিনি এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। তার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন জাপার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী ফারুক কাদের। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফার স্ত্রী মার্জিয়া সুলতানাও। স্বাভাবিকভাবেই দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর কারণে চাপে পড়তে হচ্ছে জাপাকে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে জাপা প্রার্থী রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকে লড়তে হচ্ছে নিজের শ্বশুর ও জাপার সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা এবং কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সহ-সভাপতি মঈন উদ্দিনের বিরুদ্ধে। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রভাব বেশি।

১০ আসনে জাপার বিপক্ষে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নেই। কিন্তু, স্বতন্ত্র হিসেবে যারা দাঁড়িয়েছেন তারা আওয়ামী লীগেরই সদস্য।

কুড়িগ্রাম-২ আসনে জাপা প্রার্থী পনির উদ্দিন আহমেদকে লড়তে হচ্ছে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী হামিদুল হক খন্দকারের বিরুদ্ধে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ সারোয়ার কবীরের বিরুদ্ধে গাইবান্ধা-২ আসনে জাপা প্রার্থী প্রার্থী আব্দুর রশীদ সরকার লড়াই করবেন।

সাতক্ষীরা-২ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আশরাফুজ্জামানকে মুখোমুখি হতে হবে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবির। হবিগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সংরক্ষিত সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর সঙ্গে ভোটের লড়াই করতে হবে জাপার মোহাম্মদ আব্দুল মুনিম চৌধুরীকে।

ফেনী-৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি লড়বেন সাবেক সংসদ সদস্য রহিম উল্লাহ ও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী আজিম উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে। আজিম চাকসুর জিএস ছিলেন।

মানিকগঞ্জ-১ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জহিরুল আলম রুবেলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাউদ্দিন মাহমুদ। নীলফামারী-৪ আসনে জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান লড়বেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোখছেদুল মোমিনের বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম-৮ আসনে জাপা প্রার্থী সুলেমান আলম শেঠের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুচ ছালাম। ময়মনসিংহ-৮ আসনে জাপার ফখরুল ইমাম লড়বেন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসানের বিপক্ষে। এ আসনে অবশ্য জাপা প্রার্থী সুবিধাজনক স্থানে রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিলেও বরিশাল-৩ আসনে ওয়ার্কাস পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে জাপার গোলাম কিবরিয়া টিপুকে। ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে হাফিজ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী গোপাল চন্দ্র রায়।

রংপুর-৩ আসনে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের, ময়মনসিংহ-৫ আসনে সালাহ উদ্দিন আহমেদ মুক্তি, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান, গাইবান্ধা-১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারীর শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তাই এ কয়টি আসনে জাপার জয় নিশ্চিতই বলা চলে।

কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, চট্টগ্রাম-৫ আসনে বর্তমান এমপি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কুড়িগ্রাম-১ আসনে এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান, বগুড়া-২ আসনে শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ, বগুড়া-৩ আসনে নূরুল ইসলাম তালুকদার, পটুয়াখালী-১ আসনে সাবেক এমপি এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ভোটের লড়াই করছেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী না থাকায় জাপার প্রার্থীরা এসব আসনে ভালো অবস্থানে রয়েছেন।

ঠাকুরগাঁও-৩ ও বরিশাল-৩ আসন জাপার জন্য ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে দলটির জন্য বিষফোঁড়া ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কাস পার্টির দুই প্রার্থীর। তাদের বিরুদ্ধে জাপাকে শক্ত অবস্থায় গড়ে তোলা ছাড়া উপায় খুব কম, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

আসন কমে ৬, তবু দুশ্চিন্তায় ১৪ দলের প্রার্থীরা

পি‌রোজপুর-২ আসনে টানা সাতবারের সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছেন তার এক সময়কার শিষ্য আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও পিরোজপুরের সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ।

ঢাকা-৮ থেকে তিনবার নৌকা প্রতীকে জয়লাভ করলেও এবার বরিশাল-২ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন ১৪ দলীয় জোটের বর্ষীয়ান নেতা ও ওয়ার্কাস পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত শেরে বাংলার দৌহিত্র এ. কে ফাইয়াজুল হক। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন তিনি। যদিও জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ মেননকে সমর্থন করায় তিনি এগিয়ে আছেন।

ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন রাজশাহীতে। কিন্তু তাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানো রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান। মহানগর আওয়ামী লীগ তার পক্ষেই রয়েছে বিধায় চাপে পড়েছেন বাদশা।

১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি তিনটি আসনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেয়েছেন। দলটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবারও কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। গত তিন নির্বাচনেই জয় পাওয়ায় এবারও আশাবাদী তিনি। যদিও তার সামনে রয়েছেন মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন। স্বতন্ত্র এ প্রার্থীকে হারাতে বেগ পেতে হবে ইনুকে।

লক্ষ্মীপুর-৪ আসন হঠাৎ করে নৌকা পেয়ে যাওয়া জাসদের মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধেও রয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুল্লাহ। এ আসনে জাসদকে জিততে হলে চমক দেখাতে হবে। বগুড়া-৪ আসনে নৌকা নিয়ে দুইবার সংসদ সদস্য হওয়া জাসদ নেতা রেজাউল করিম তানসেন আওয়ামী লীগের পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন। কিন্তু বিএনপির চারবারের সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মোল্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় তার ভাগ্যও ঝুলে পড়েছে।