দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বছরজুড়ে আন্দোলন করেছে বিএনপি। দফায় দফায় হরতাল, অবরোধের পর বিএনপি শুরু করে অসহযোগ কর্মসূচি।নতুন বছরে প্রত্যাশা পূরণের কথা জানিয়েছেন দলটির নেতারা।

 

চলতি বছরের শুরুতেই বড় শোডাউনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনে বিজয়ের বার্তা দিচ্ছিল বিএনপি। কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও ফুটে উঠেছিল দারুণ আশা। কিন্তু গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশে পুলিশের সঙ্গে নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ এবং এর পরের পরিস্থিতি সব কিছু পাল্টে দেয়। ওই সমাবেশে পুলিশকে পিটিয়ে মারার অভিযোগে বিএনপির ওপর আবারো শুরু হয় ক্র্যাকডাউন। দলটির মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হন। দলীয় কার্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। দেশজুড়ে নেতা-কর্মীরা মামলা-গ্রেপ্তারের আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে পড়েন। তবে এমন অবস্থায়ও কর্মসূচি বন্ধ করেনি বিএনপি। ২৯ অক্টোবর থেকে পর্যায়ক্রমে চলছে হরতাল-অবরোধ।

২০২৩ সাল নির্বাচনি বছর ধরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জানুয়ারি থেকেই সরকারের পতনের আন্দোলনে সরব হয়ে ওঠে বিএনপি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়ে চলে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আর এ প্রক্রিয়া শুরু হতে দেখা যায় ২০২২ সালের অক্টোবরে। ওই অক্টোবরে সারা দেশে সাংগঠনিক বিভাগগুলোতে ধারাবাহিক সমাবেশ কর্মসূচি করে বিএনপি, যা শেষ হয় একই বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠের সমাবেশের মধ্য দিয়ে। সেই সমাবেশ থেকে সংসদ বিলুপ্ত, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিসহ ১০ দফা ঘোষণা করে দলটি।

নানা কর্মসূচির মধ্যে এগোতে থাকা বিএনপি বছরের মাঝামাঝিতে আসে এক দফায়। গত ১২ জুলাই রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ থেকে ঘোষণা হয় সরকার পতনের এই এক দফার ডাক। এক দফা ঘোষণায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘দেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েশি সাজা বাতিল এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক জোট ও দলগুলো যুগপৎ ধারায় ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তোলা ও সফল করার লক্ষ্যে এই এক দফা। ’ এই সমাবেশে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন, যা ছিল দলের নেতাকর্মীদের কাছে চমক। সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ দলের কর্মসূচিকে বেগবান করেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ করে বিএনপি। ওইদিন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। পরদিন ২৯ অক্টোবর ঢাকার সব প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি দেওয়া হয়। একদিন বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু হয় তিন দিনের অবরোধ। ওই মহাসমাবেশের পরপরই দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হন। এরমধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলটির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাও কারাবন্দির জীবন শুরু করেন। এরপর গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান মাঠে সক্রিয় থাকা অন্য অনেক নেতাকর্মীও।

বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া কর্মসূচি তফসিল ঘোষণার পর গতি পায়। তারা দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিতে শুরু করে। ৩১ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ১২ দফায় ২৩ দিন অবরোধ এবং চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল পালন করে বিএনপি ও সমমনারা। ১৯ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের পর আর কোনো হরতাল কর্মসূচি আসেনি এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত।

এরইমধ্যে ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করে সর্বসাধারণের প্রতি সরকারকে অসহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। গত ২০ ডিসেম্বর সরকারের পদত্যাগ দাবিতে সারা দেশে এ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় দলটি। একই দিন ২১, ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশে গণসংযোগ এবং ২৪ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা করে তারা। আর ২৬, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর সারা দেশে গণসংযোগ এবং লিফলেট বিতরণ করে দলটি।

এদিকে বছরজুড়েই দলের অসুস্থ চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ইস্যুটিও ছিল বিএনপির আলোচনার কেন্দ্রে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে কারামুক্ত খালেদা জিয়া বর্তমানে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কখনও কেবিনে আবার কখনও আইসিইউতে রেখে তার চিকিৎসা চলছে। এরই মধ্যে গত ২৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় এসে ২৬ অক্টোবর খালেদা জিয়ার অস্ত্রোপচার করেন। বছরের শেষ দিকে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতির খবর আসে। তবে, এ মুহূর্তে বাসায় ফিরতে পারছেন না তিনি। থাকতে হচ্ছে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে নেতাকর্মীদের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সময় আরও বেড়ে গেল। যদিও সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সক্রিয় থাকা বিএনপি এবার দাবি পূরণ নিয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিল। তার বড় কারণ ছিল নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা। বিশেষ করে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী অনেক দেশ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে তৎপর হওয়ায় আশায় বুক বেঁধে ছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। কিন্তু আপাতত আশাই ভরসা বিএনপির। কারণ বিদেশিদের তৎপরতায় কিংবা আন্দোলনে থেমে থাকেনি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ট্রেন।

অবশ্য নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে মাঠে থাকা দলটির নেতারা আশা করছেন, ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও সরকার টিকে থাকতে পারবে না। তাদের আন্তর্জাতিক মহলের কঠিন চাপের মুখে পড়তে হবে। ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, সরকার জোর করে নির্বাচন করে ফেললেও টিকতে পারবে না। কারণ এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা দেশে-বিদেশে কোথাও পাবে না। আমাদের যে আন্দোলন চলছে তা অব্যাহত থাকবে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কর্ণপাত করছে না। সরকার ধরেই নিয়েছে একতরফা নির্বাচন করে ফেলবে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি কঠোর আন্দোলনের বিকল্প দেখছে না। ফলে ঢিমেতালে অবরোধ কর্মসূচি না দিয়ে এবার সর্বশক্তি দিয়ে দু-তিন দিনের কঠোর আন্দোলনে যেতে চায় দলটি। মাঠ পর্যায়ের নেতারা গ্রেপ্তার আতঙ্কে বর্তমানে কৌশলী অবস্থানে থাকলেও বছর শুরুর কঠোর আন্দোলনে মাঠে নামার পরিকল্পনা নিয়েছে।