নির্বাচনকে বিতর্কিত বলছে বিবিসি
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: দেশ-বিদেশে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই গতকাল রোববার (৭ জানুয়ারি) বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বেসরকারিভাবে নির্বাচনের ফলও ঘোষণা করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২২৩ আসনে বিজয়ী হয়েছে। তাছাড়া স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হওয়া ৬২ জনের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের লোক। বাংলাদেশের এই নির্বাচন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। প্রতিবেদনে এই নির্বাচনকে বিতর্কিত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটির শিরোনাম এ রকম- ‘বাংলাদেশের নির্বাচন: বিতর্কিত ভোটে চতুর্থবারের মতো জয়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’।
সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, বিতর্কিত এক নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদ নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে তার দল আওয়ামী লীগ ও মিত্ররা ২২৩টি (পরবর্তীতে আরও একটি আসন পেয়েছে দলটি) আসনে জয়ের পর তিনি আরও ৫ বছর মেয়াদে দায়িত্ব শুরু করবেন। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায়, শেখ হাসিনার দল ও মিত্ররা বাকি আসনগুলোতেও যথারীতি বিজয়ী হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
একে লজ্জার নির্বাচন বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। বিএনপির নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে গণগ্রেফতারের পর রোববারের নির্বাচনে এই ফল এসেছে। সরকারি হিসাব বলছে, কম ভোটার ভোট দিয়েছেন। এ সংখ্যা শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এই সংখ্যা বাড়িয়ে বলা হয়ে থাকতে পারে। তুলনামূলকভাবে ২০১৮ সালে গত নির্বাচনে ভোট পড়েছিল শতকরা ৮০ ভাগের বেশি। এবার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৪৫ (শেষ পর্যন্ত ৬২ আসন পেয়েছে স্বতন্ত্র) আসনে এবং জাতীয় পার্টি জিতেছে ৮ (শেষ পর্যন্ত ১১ আসন পেয়েছে দলটি) আসনে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের।
আজ সোমবার সরকারি ফল ঘোষণা করার কথা।
এটা নিয়ে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্ব ৫ম মেয়াদের। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৯ সালে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ক্ষমতায় আছেন। ভোট দেওয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, এ দেশে যাতে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকে তা নিশ্চিত করতে আমি সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, দলীয় নেতা ও কর্মীদেরকে বিজয় বা আনন্দ মিছিল না করার নির্দেশনা দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাব অনুযায়ী, ২৮ অক্টোবর বিরোধী দলের মহাসমাবেশ সহিংস হয়ে উঠার পর প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সহিংসতাকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫ হাজার ৫০০ মানুষ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধীদের দিয়ে জেলখানা ভরে ফেলেছে সরকার- এমন অভিযোগ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এই নতুন বিজয়ের ফলে আওয়ামী লীগ কার্যত একদলীয় শাসনে নেতৃত্ব দিতে পারে বলে আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। খুব কম মানুষই মনে করেন, সরকার তার দমনপীড়ন শিথিল করবে। যদি বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজের গ্রুপগুলো সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই থাকে তাহলে তাতে দমনপীড়ন আরও বেশি হতে পারে।
নির্বাচন তদারকির জন্য একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। তাদের সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ। এর পর নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, ‘আমাদের শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলন অব্যাহতভাবে আরও গতি পাবে’। নির্বাচনকে সামনে রেখে অগ্নি সংযোগের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিক্ত বিরোধী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে। ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে নির্বাসনে বসবাস করছেন। দুর্নীতির অভিযোগে বর্তমানে গৃহবন্দি খালেদা জিয়া। ২০০৪ সালে তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার একটি সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৮ সালে তারেক রহমানকে তার অনুপস্থিতিতে অভিযুক্ত করে আদালত এবং তাকে যাবজ্জীবন জেল দেয়। ওই হামলায় আহত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা এবং নিহত হয়েছিলেন কমপক্ষে ২০ জন। অভিযোগকে ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিক প্রতিশোধ বলে দাবি করা হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে ভোটারদেরকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানায় বিএনপি। কিন্তু শেখ হাসিনার সমর্থকরা বলেন, তিনি বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় ব্যাপক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছি। তা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিয়েছে। আমি মনে করি, এজন্য শেখ হাসিনাকে কৃতিত্ব দেওয়া উচিত বিশ্বের।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা একা গত ১৫ বছরে সবচেয়ে বড় যে অর্জন করেছেন তা হলো আস্থা। বাংলাদেশের মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন তিনি। তারা নিজেদের ওপর বিশ্বাস এনেছেন।
শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ একটি বিপরীত চিত্র তুলে ধরে। বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশটি ২০০৯ সাল থেকে তার নেতৃত্বে বিশ্বাসযোগ্য অর্থনৈতিক সফলতা অর্জন করেছে। এটি এখন এ অঞ্চলে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। এমনকি তা জায়ান্ট প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে। গত এক দশকে এখানে মাথাপিছু আয় তিনগুন হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে গত ২০ বছরে কমপক্ষে আড়াই কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে তুলে আনা হয়েছে। চীনের পর এ দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গার্মেন্ট প্রস্তুতকারক।
কিন্তু করোনা ভাইরাস মহামারি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর ২০২২ সালের মধ্যভাগে এই অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়ে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং আগে থেকে শুরু হওয়া আইএমএফের শর্ত সঙ্গে করে জনগণের সমস্যা মোকাবিলায় সংগ্রাম করতে পারে সরকার। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক চাপ আসতে থাকে।
দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত বা খর্ব করার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ওপর সেপ্টেম্বরে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু করে ওয়াশিংটন। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ করার কারণে উদ্বেগ জানায় জাতিসংঘ ও অন্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো। কিন্তু শেখ হাসিনা এ বিষয়ে অবগত যে, যতদিন তার পিছনে ভারত আছে, ততদিন পশ্চিমাদের যে কোনো রকম বড় নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করা যাবে। উন্নত দেশগুলো এ সম্পর্কে অবহিত যে, বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পকে দেওয়া সুবিধাগুলো প্রত্যাহার করা হলে তাতে কয়েক লাখ শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এর বেশির ভাগই নারী।
১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। তিনি ২০০৯ সালে আবার নির্বাচিত হন। তখন থেকেই ক্ষমতায় আছেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী নেতায় পরিণত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই মেয়াদ শেষে তার বয়স হবে ৮১ বছর। বাংলাদেশের বহু মানুষের মধ্যে, এমন কি আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যেও একটি বড় প্রশ্ন- তার উত্তরসূরি কে হবেন।
কিছু বিশ্লেষক বলেন, নির্বাচনের ফল স্পষ্ট। কিন্তু ভবিষ্যত অনিশ্চিত।