আশংকাজনক ভাবে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু
এইডস : উচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
হাসান আরিফ, দ্য রিপোর্ট: সরকারি সর্বশেষ তথ্য মতে ২০২২ সালে এইডসে আক্রান্ত হয়ে আড়াইশর বেশি মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশে, বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যাও। আশংকাজনক মৃত্যু ও আক্রান্তের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অস্ত্রোপচার, সিরিঞ্জ, সারাবিশ্বে অবাধ যাতায়াত ও অসুরক্ষিত যৌনমিলনসহ চিকিৎসায় রি-ইউজেবল অনেক কিছু ব্যবহার করা। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের নেওযা কর্মসূচির আওতায় এইডস রোগীদের চিকিৎসার আওতা বাড়ানো হয়েছে। নেওয়া হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘জাতীয়যক্ষ্মা, কুষ্ঠ ও এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে বাংলাদেশে নতুন করে এইডস শনাক্ত হয়েছে ১২৭৬ জনের, এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৯৪৭। আর এই সময়ে এইডসে আক্রান্তদের মধ্যে ২৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে; আগের বছর ২৩২ জনের মৃত্যু হয়।
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এক বছরে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর এই সংখ্যাকে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ৩৪ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে এইডসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ৯৮৪ জন। একই সয়ে মৃত্যু হয়েছে ২০৮৬ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, "বাংলাদেশে এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী মানুষের সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি, এর একটা অংশ শনাক্তের বাইরে। "সরকার আশা করছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৯৫ শতাংশ এইডস রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা যাবে। বাকি ৫ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় আনতে আরো কয়েক বছর সময় লাগবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত এক বছরে আক্রান্তদের মধ্যে বাংলাদেশি ১১১৮ জন, বাকিরা কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করা রোহিঙ্গা। এক বছরে আক্রান্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৪২ জন রোগী রাজধানী ঢাকার। এছাড়া চট্টগ্রামে ২৪৬ (এর মধ্যে ১৫৮ জন রোহিঙ্গা), রাজশাহীতে ১৭৫, খুলনায় ১৪১, বরিশালে ৭৯, সিলেটে ৬১, ময়মনসিংহে ৪০ এবং রংপুর জেলায় ৩৪ জন এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এদিকে, ইউনিসেফ বলছে, এইডস-সম্পর্কিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু হতে পারে। এইচআইভি প্রতিরোধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা প্রকল্পে বাড়তি বিনিয়োগ করা না হলে প্রতিদিন ৭৬ জন কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু হবে।
সংস্থাটির ‘শিশু, এইচআইভি ও এইডস: ২০৩০ সালের বিশ্ব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান ধারা বজায় থাকলে এইচআইভিতে আক্রান্ত ০-১৯ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে আনুমানিক ২ লাখ ৭০ হাজারে পৌঁছাবে, যা বর্তমানের অনুমানের চেয়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশেও এইডসের বর্তমান পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৯৫ ভাগকে চিকিৎসার আওতায় আনার লক্ষ্য জাতিসংঘের। সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান ডা. জাহিদুল কবির বলেন, ‘আশপাশের দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এইডস রোগী কম। তবুও আমাদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি। তা না হলে আমাদের দেশেও এইডসের ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা আছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশকে এখন বলা চলে—লো প্রিভিলেন্স। মূলত, এইচআইভির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হাই রিস্ক কান্ট্রি। এখন আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও যেকোনো সময়ে এটি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’
আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ার কারণ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, বাংলাদেশ অনেক রোগ নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও এইডস নিয়ন্ত্রণে থমকে আছে। আমাদের এখানে অস্ত্রোপচারসহ চিকিৎসায় রি-ইউজেবল অনেক কিছু ব্যবহার করা হয়। ওই জিনিসগুলো জীবাণুমুক্ত করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে দেখা যাবে একজন নির্দোষ ব্যক্তি যিনি একটি কোলনস্কপি, এন্ডোস্কপি বা যে কোনো একটা পরীক্ষা করাতে এসে আক্রান্ত হয়ে গেলেন। এছাড়া যারা ইনজেকশন ব্যবহার করে শিরায় মাদক নেন, সেইসব মাদকসেবীরাও এইডসে আক্রান্ত হচ্ছেন। যার ফলে রোগীর সংখ্যাং বাড়ছে। তিনি এইডস নির্মূলে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় আরও বেশি জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, রোগটি যাতে সংক্রমিত না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তবে আক্রান্তদের দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না। সরকার এইডসের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধসহ সব ধরনের সেবা দিচ্ছে।
রোগটি বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীরের মতে, মানুষ এখন সারাবিশ্বে অবাধ যাতায়াত করছে। ফলে সংক্রামক রোগও দ্রুত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছড়িয়ে যাচ্ছে।
মৃত্যুর বেড়ে যাওয়ার সম্ভাব্য দুইটি কারণ তুলে ধরেন চিকিৎসক আহমেদুল কবীর বলেন, আগে হয়তো অজ্ঞাত রোগ হিসেবে মারা যেত। এখন এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ভালো হওয়ায় রোগী শনাক্ত বেশি হচ্ছে, কারণ এইডস আক্রান্তের মৃত্যু এইডস হিসেবেই চিহ্নিত করা হচ্ছে। আরেকটা হতে পারে বাংলাদেশে যারা এইডস আক্রান্ত তাদের বয়স হয়েছে, তাদের অনেকের স্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নতুন রোগীদের বড় অংশই অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্য। আগে ঝুঁকিপূর্ণ চার ধরনের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন রোগী বেশি পাওয়া গেলেও গত বছর সাধারণ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ বেড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, নারী যৌনকর্মী, সমকামী/পুরুষ যৌনকর্মী এবং হিজড়া—এই চার ধরনের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকি বেশি। ইউএনএইডসের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, সাধারণ মানুষের চেয়ে যৌনকর্মীদের এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকি ২১ গুণ বেশি। বাংলাদেশে এক লাখের বেশি নারী যৌনকর্মী আছে। তাদের মধ্যে কিশোরীদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। তারা প্রয়োজনের সময় সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না।
প্রতিকারের উপায়
প্রাণঘাতী এইডস নিরাময়ে সরকারকে আরও বেশি পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এজন্য শনাক্তকরণ পরীক্ষা এবং আওতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। বিশেষ করে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, অভিবাসী, পুশব্যাক হওয়া লোকজন এবং এইডসপ্রবণ এলাকাগুলোর দিকে বেশি নজর দেওয়া। করোনা পরীক্ষার মতোই সীমান্ত এলাকায় সবাইকে এইচআইভি টেস্টের আওতায় আনার পক্ষেও মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জাতিসংঘের এইডস-বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইডসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন এইডস রোগী মোট জনসংখ্যার ০.১ শতাংশ। বাংলাদেশে এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী মানুষের সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি। তবে, চিকিৎসার আওতায় আছেন মাত্র ৫০ শতাংশ রোগী। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সর্বশেষ শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৬ হাজার ১০৪ জনকে চিকিৎসা সুবিধার আওতায় আনা গেছে। বাকি সংক্রমিত ব্যক্তি এখনো চিকিৎসার বাইরে আছেন। তবে, বাংলাদেশের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল বিভাগ দাবি করছে, আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবার আওতায় নিয়ে আসার হার প্রতিবছর বাড়ছে। এইডস হয়েছে কি না, সে বিষয়ে ২০১৯ সালে সচেতনতার হার ছিল ৫২ শতাংশ, যা ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ শতাংশে। দুই বছর আগের চিকিৎসাসেবার আওতায় থাকা রোগী ছিল ৬৫ শতাংশ, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৭৭ শতাংশে।
বাংলাদেশে এইডসের ইতিহাস
বাংলাদেশে প্রথম ১৯৮৯ সালে এইচআইভি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে ১০, ২০, ১০০ বা ২০০ জন করে নতুন রোগী প্রতিবছর শনাক্ত হয়েছে। ২০১৮ সালে নতুন রোগী বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬৯ জনে। এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম এক রোগী মারা যায় ২০০০ সালে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে আরও ৭২৯ জনের দেহে এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী আছিল ১৮৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক এবং টিবি-লেপ্রোসী ও এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. খুরশীদ আলম বলেন, ‘দেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার কম, মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। সংক্রমণের হার কম হলেও ঘনবসতি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন এবং অসচেতনতার কারণে এইচআইভির ঝুঁকি আছে। পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় এইচআইভি সংক্রমণের হার অনেক বেশি হওয়ায় বাংলাদেশেও ঝুঁকি বাড়ছে।
দেশে এইডসের চিকিৎসা ও সেবার পরিধি
বাংলাদেশ কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটিং মেকানিজমের সদসস্য বলছেন, দেশে এইডসের চিকিৎসা ও সেবার পরিধি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণেই আছে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতার অভাবে সরকারের অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে, বেসরকারি পর্যায়ে এখনও এইডসের চিকিৎসাসেবা তেমন একটা চালু করা যায়নি। বাংলাদেশে সরকারিভাবে এইডসের চিকিৎসা দেওয়া হয়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের সব জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ মোট ৯৭ ব্লাড ট্রান্সফিউশন সেন্টার এইচআইভি স্ক্রিনিং করছে। এছাড়া বেসরকারি বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগে এইচআইভি স্ক্রিনিং করা হয়। এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্যকরী যোগাযোগ স্থাপন এবং স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সব এইচআইভি কেস কনফার্মেটরি টেস্টে অন্তর্ভুক্ত করে চূড়ান্ত পরীক্ষা সম্পন্ন করার নির্দেশনা প্রদান করেছে। সারা দেশে ১১টি কেন্দ্র থেকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এইডসের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। বেশিরভাগ রোগী বাড়িতে থেকে চিকিৎসাসেবা নেন। তবে, তাদের নির্ধারিত কেন্দ্র থেকে নিয়মিত ওষুধ সরবরাহ করতে হয় এবং চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। বড়দের ক্ষেত্রে মুখে খাওয়ার ওষুধ আর শিশুদের জন্য সিরাপ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে কারও যদি এইডসের পাশাপাশি অন্য কোনো শারীরিক জটিলতা থাকে, তাহলে তার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সে রোগের চিকিৎসা নিতে হয়।
উদ্বেগ বাড়িয়েছেন দেশে ফেরা প্রবাসীরা
২০১৯ সালের পর থেকে করোনার কারণে বৈধ এবং অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়া অনেকেই দেশে ফিরেছেন। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, নতুন শনাক্ত এইডস রোগীদের মধ্যে অভিবাসীর সংখ্যা বেশি। এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও সংক্রমণের হার বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পরীক্ষার বাইরে কিছু জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে। এছাড়া, কয়েক বছর ধরেই দেখা গেছে, অভিবাসীদের কেউ কেউ এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জরিপে এইচআইভিতে আক্রান্ত নতুন রোগীদের ৩০ শতাংশ অভিবাসী কর্মী বা তার পরিবারের সদস্য।
সচেতনতার অভাব
এইডস বিষয়ে এখনো সচেতনতা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে, ধীরে ধীরে সচেতনতা বাড়ছে। সচেতনতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির কর্মকর্তারা বলছেন, এইচআইভিতে আক্রান্তদের ৫০ শতাংশই জানেন না যে, তাদের এ রোগ হয়েছে। যারা জানেন, তাদের এক–তৃতীয়াংশের বেশি চিকিৎসা নেন না। আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়মিত ওষুধ (অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল) সেবন করতে হয়, রক্ত পরীক্ষা করাতে হয়। তবে, চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের শারীরিক পরিস্থিতি কী, সেই তথ্য সরকারের কাছে নেই। যদিও ২০১৯ সালের শেষদিকে এ বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণের কাজ শুরু করে সরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার ব্যাপক হারে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে। মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। আগে যৌনকর্মীরা অসচেতন ছিলেন। এখন তারা অনেক বেশি সচেতন। এছাড়া, বিদেশফেরত প্রবাসীরাও এখন অনেক বেশি সচেতন। সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা সম্ভব হলে এইডসের ঝুঁকি আরও কমানো সম্ভব।
এইডস একটি জেন্ডার ইস্যু
১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এইডসআক্রান্তের সন্ধান পাওয়া যায়। শনাক্তকৃত প্রথম পাঁচজনই ছিলেন পুরুষ সমকামী। বাংলাদেশেও প্রথম একজন পুরুষের শরীরেই এইডস শনাক্ত করা হয়। সুতরাং বৈশ্বিক ও স্থানীয় দুই প্রেক্ষিতেই এ রোগের সূত্রপাতকারী হচ্ছেন পুরুষ। অথচ এইডসের ক্ষেত্রে নারীকেই সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। যেমন, ২০০৪ সালের এইডস দিবসের শ্লোগান ছিল, ‘এইডস : নারীরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ’। নারী যে এইডসের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির শিকার এ 'শ্লোগান তা আড়াল করেছে। বলা হচ্ছে, নারী তার শারীরিক গঠনের কারণে এইডস বিস্তারের ক্ষেত্রে পুরুষের চাইতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু উপস্থাপনের ধরন এমন ধারণা নির্মাণ করে, যেন নারীর যৌনাঙ্গ এইডসসহ সকল রোগের আখড়া। এ ধরনের তথ্যের উদ্দেশ্যমূলক প্রচার নারীকে অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে এবং তা নারীর ক্ষেত্রে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নারীকে এইডস আক্রান্ত করে পুরুষ। এ রোগ বিস্তারের সম্ভাব্য সব উপায়ই পুরুষের দখলে। এমনকি প্রতিকার ও প্রতিরোধেও পুরুষের ভূমিকাই সর্বাধিক। অথচ নারী একদিকে এ রোগের সর্বোচ্চ শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ‘অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে নারীকেই প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে এইডস কেবল একটি রোগের নাম নয়, এটি হয়ে উঠেছে একটি জেন্ডার ইস্যু। সংশ্লিষ্ট প্রকাশনায় এ রোগ বিস্তারে পুরুষের দায়-দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে আসছে না। বরং নারীকে এ রোগের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিবেচনা করে প্রতিরোধের সম্ভাব্য করণীয়সগুলো নারীকে কেন্দ্র করেই বাতলানো হচ্ছে, যেখানে দায়িত্বটা বেশি পুরুষের।
(দ্য রিপোর্ট/ হা আ / মাহা/ দশ জানুয়ারী দুই হাজার চব্বিশ)