দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলনের সফলতা ও ব্যর্থতা মূল্যায়ন করছে বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর আগে ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ করার বিষয়েও মত দেন নেতারা। 

 

মঙ্গলবার স্থায়ী কমিটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে হাইকমান্ডের পৃথক ভার্চুয়াল বৈঠকেও আন্দোলনের মূল্যায়ন হয়। এসব বৈঠকে ভোট বর্জনের ডাকে জনগণ সাড়া দিয়েছে দাবি করে আন্দোলন সফল বলে মত দেন নেতারা। তবে কেউ কেউ আত্মসমালোচনাও করেন। সেখানে কর্মসূচি বাস্তবায়নে সাংগঠনিক কিছু দুর্বলতার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি মাঠ না ছাড়ার বিষয়েও একমত হন তারা। সেজন্য কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

এছাড়া এদিন বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের দপ্তরে থাকা নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক হয়। সেখানে কারাগারে থাকা নেতাকর্মীদের জামিনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ তালিকা চাওয়া হয়েছে। এজন্য বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের আরও তৎপরতা বাড়ানোর জন্য তাগিদ দেওয়ার প্রসঙ্গও ওঠে। এ নিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গেও আজকালের মধ্যে বৈঠক করার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ভোটের পর থেকেই সমমনাদের পাশাপাশি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনসহ দলটির তৃণমূল ও সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে হাইকমান্ড। বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা জানান, ভোটের পর ‘নীরবতা’ মানে এই নয় যে, আন্দোলনরত দলগুলো কিছু করছে না। জনগণের ভোট বর্জনই সবচেয়ে বড় সাফল্য তাদের। ভোট সুষ্ঠু হয়নি বলে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ বিবৃতিও দিয়েছে। তাদের তৎপরতার দিকেও নজর রাখা হচ্ছে। ভোটে ‘অনিয়ম’ ও ‘কারচুপি’র নানা তথ্য-উপাত্ত বিদেশি দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় পাঠানো হয়েছে। আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে, যা পাঠানো হবে। বিশেষ করে ভোট সুষ্ঠু হয়নি, কারচুপি হয়েছে তা এখন খোদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক দলের নেতারাও বলতে শুরু করেছেন।

দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ নিজেরা মারামারিতে জড়াচ্ছে, হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। ভোটের পরপরই কোনো কঠোর কর্মসূচিতে গেলে বিএনপির ওপর দায় চাপানো হতো। তাই একটু সময় নিয়ে মাঠের কর্মসূচিতে নামতে চায় দলটি। ১৯ জানুয়ারি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী। সে উপলক্ষ্যে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি পালন করা হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর আগে ঢাকায় সমাবেশসহ কিছু কর্মসূচি করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। শিগরগিরই তা চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘জনগণ নর্থ কোরিয়া স্টাইলের নির্বাচন আর একদলীয় গণতন্ত্র চায় না। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর চলমান আন্দোলনে জনগণের বিজয় এবং শেখ হাসিনার (প্রধানমন্ত্রী) পরাজয় হয়েছে। গণতন্ত্রের আন্দোলন থামবে না। এর স্রোতধারা আরও বেগবান হয়ে মাফিয়া ফ্যাসিস্টদের পতন ঘটাবে। কর্মসূচির বিষয়ে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। চূড়ান্ত হলে জানানো হবে।’

তিনি বলেন, ‘ভোটারবিহীন ডামি নির্বাচন, ফলাফল, ভোটের হার বাড়ানোর ছেলেখেলা-তামাশা-নাটক সবকিছুই নিবিড়ভাবে অবলোকন করেছে পৃথিবীবাসী-মিডিয়া ও বিভিন্ন দেশের সরকার ও পর্যবেক্ষকরা। সুতরাং তামাশার নির্বাচন বাতিল ও রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ধ্বনিত হচ্ছে।’

গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আন্দোলনের সাফল্য ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। এত বিশাল সম্ভাবনার পরও কেন আমরা সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারলাম না, অর্থাৎ লক্ষ্যটা অর্জন করতে পারিনি সেসব মূল্যায়ন করছি। আন্দোলনের একধাপ ৭ জানুয়ারি শেষ হয়েছে। মানুষ যেভাবে ভোট বর্জন করল, এ বর্জনের মধ্যে দিয়ে যে গণঅনাস্থা তা কিভাবে রাজপথে দানা বাঁধানো যাবে-সেটাই এখন মনোযোগের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এখন আন্দোলনটা আরেকটু নতুনভাবে পুনর্বিন্যাস হবে। তার ধরন ও কৌশল নিয়ে আলোপ-আলোচনা হচ্ছে। ঢাকায় একটি সমাবেশ করার বিষয়েও আলোচনা চলছে। আর সভা-সমাবেশ, গণসংযোগ, অবস্থান, বিক্ষোভ এগুলোও আলোচনায় আছে।’

তিনি বলেন, ‘যারা নির্বাচনে গেছে তারাও তো নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছে। সুতরাং মেসেজটা পরিষ্কার, এখন আন্দোলনরত দলগুলো কিভাবে এগোবে-সেটা নিয়ে কতাবার্তা হচ্ছে। মানুষকে এখন আবারও মাঠে নামানোই হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। বৃহস্পতিবার গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠক রয়েছে। আগামী সপ্তাহে বিএনপির সঙ্গেও বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।’

সূত্র জানায়, মঙ্গলবার রাতে তিন দফায় ধারাবাহিক বৈঠক হয়। সর্বশেষ বৈঠক হয় স্থায়ী কমিটির। এতে অংশ নেওয়া বিএনপির একাধিক নেতা জানান, সেখানে ভোটে অনিয়ম, ভোট পরবর্তী আন্দোলন নিয়ে অনেক সময় ধরে আলোচনা হয়েছে। কর্মসূচি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। নেতারা বলেন, ‘দলীয় হাইকমান্ডের মনোভাব তারা এখনো বুঝতে পারছেন না। তবে সঠিক সময় তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত দেবেন বলে আশা করছি।’

বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ২৬ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে এখনো কারাগারে রয়েছেন-মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী, হাবিবুর রহমান হাবিব ও আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও খায়রুল কবির খোকন, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, সদস্য সচিব ও দলের প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমেদ, সমবায়বিষয়ক সম্পাদক জিকে গউছ। সহ-সম্পাদকদের মধ্যে কারাগারে আছেন সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল আলম, সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, সহ-স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, সহ-গ্রাম সরকার বিষয়ক সম্পাদক বেলাল আহমেদ ও সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কাজী আবুল বাশার। নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু সাঈদ চাঁদ, সাইয়েদুল আলম বাবুল ও ফজলুর রহমান খোকনও কারাগারে রয়েছেন।

এছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হকসহ জেলা ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অন্তত ৩১ জন কারাগারে আছেন। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, কারাবন্দি নেতাকর্মীদের জামিনে মুক্ত করাকেই এই মুহূর্তে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সারা দেশে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের আইনজীবী যারা আছেন, নির্দেশনা দেওয়ার আগেই তারা কাজ শুরু করেছেন। আইনি সহায়তা দেওয়া এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা অব্যাহত আছে এবং থাকবে।’