বেআইনিভাবে শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে এনআরবিসির মালিকানা দখল
তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু: ব্যাংকিং নীতিমালার অনেক কিছুই মানছে না এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক লিমিটেড। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নির্বাহী চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সব নিয়ম-কানুন ভেঙে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের ১০ শতাংশ শেয়ার, ব্যাংকের মালিকানায় থাকা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের ৯ শতাংশ শেয়ার ও ব্যাংকের বাজেয়াপ্ত ঘোষিত সাড়ে ৫ শতাংশ শেয়ার নিজেদের নামে বরাদ্দ ও দখল করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমাল, ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মিয়া আরজু ও এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমাম এসব বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত। তাদের এই কর্মকান্ডের পিছনে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
দ্য রিপোর্টের হাতে এসব অভিযোগের প্রমাণপত্র এসেছে। নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায় , ২০১৫ সালের ৫ মে এনআরবিসি ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি হিসেবে এনআরবিসি ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেড ব্রোকারেজ ব্যবসার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাভ করে। এর পরিশোধিত মূলধন ছিল ৪০ কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী, সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের শতভাগ মালিকানা থাকবে ব্যাংকের নামে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার ব্যাত্যয় ঘটিয়ে এনআরবিসি সিকিউরিটিজের ১০ শতাংশ শেয়ার নিজেদের নামে করে নেন পারভেজ তমাল, রফিকুল ইসলাম মিয়া আরজু ও আদনান ইমামসহ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কয়েকজন।
আরো দেখা যায়, ব্যাংকের পরিচালক থাকা অবস্থাতে ব্রোকারেজ হাউজের চেয়ারম্যান হন পারভেজ তমাল। যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের পরিপন্থী। ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ১৮ (২) ধারা অনুযায়ী, সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের অবগতির জন্য বার্ষিক প্রতিবেদনে যেকোনো শেয়ারহোল্ডিংয়ের তথ্য প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে শেয়ারহোল্ডিংয়ের কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। যা ১৮ এর ৬ ধারা অনুযায়ী পরিচালক পদ থেকে বরখাস্ত যোগ্য অপরাধ। গুরুতর এই আইন ভঙ্গ করেও পারভেজ তমাল ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নানা ধরণের ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে সংখ্যাধিক্য পরিচালকদের সমর্থন আদায় করে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ব্যক্তিমালিকানায় ধারণের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসে ২০২১ সালের শেষ দিকে। বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে ব্রোকারেজ হাউজের মালিকানা পুনরায় ব্যাংকের কাছেই ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেয়। এই আদেশ পেয়ে অভিনব এক কৌশল বেছে নেন ওই তিনজন।
তারা ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ১০ শতাংশ শেয়ার ব্যাংকের কাছে ২০ টাকা দামে বিক্রয়( বাইব্যাক) করেন। ফলে শেয়ারহোল্ডাররা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির শিকার হন।
মুল এনআরবিসি ব্যাংকটি ২০২১ সালের মার্চে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ১২ কোটি শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে ১২০ কোটি সংগ্রহ করে। সেকেন্ডারি বাজারে যখন এই শেয়ারের লেনদেন ১৩ থেকে ১৫ টাকা দরে হচ্ছে তখন নিজেদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানির শেয়ার ২০ টাকা দরে বাইব্যক করা হলো। তাতে ৪০ লাখ শেয়ারে ক্ষতি হয় প্রায় ৪ কোটি টাকা।
২০১৮ সালে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট নামে একটি স্বতন্ত্র কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন তমাল, আরজু ও আদনান। যাত্রা শুরুর সময়ের আরজেএসসি অনুমোদিত সংঘবিধি অনুসারে ব্যাংকের মালিকানায় এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের ২ লাখ বা ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ শেয়ার ছিল।
অপরদিকে ৪ লাখ ১৫ হাজার ৩৮৩টি বা ১৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা গ্রহণ করেন পারভেজ তমাল। রফিকুল ইসলাম মিয়া আরজু ও আদনান ইমামের প্রত্যেকের ১ লাখ ৩৮ হাজার ৪৬১টি বা ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ করে শেয়ার ছিল।
পরবর্তীতে পারভেজ তমাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থাতে ২০২০ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এক সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ব্যাংকের মালিকানাধীন এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের ২ লাখ শেয়ার অন্য কোনো শেয়ারহোল্ডারের নামে হস্তান্তর করা হবে।
সেই সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়ে পারভেজ তমাল নিজের নামেই ওই শেয়ার হস্তান্তর করিয়ে নেন। ফলে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের ৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৮৩টি বা ২৮ দশমিক ১২ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেন পারভেজ তমাল। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, পারভেজ তমাল নিজের নামে এই শেয়ার লিখে নিতেই কি ব্যাংকের পর্ষদের মাধ্যমে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের ২ লাখ শেয়ার হস্তান্তরের অনুমোদন করিয়েছেন?
এহেন কার্যক্রমের ফলে কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট উদ্ভব হয়েছে। যা ব্যাংকের সাধারণ শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীর স্বার্থ ক্ষুন্ন করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এরপর ওই বছরের ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর পারভেজ তমাল ও আদনান ইমামের যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি এ অ্যান্ড পি ভেঞ্চার লিমিটেডের নামে (হাউজ: ৯, রোড: ২৫/এ, ব্লক: এ, বনানী, ঢাকা ) নতুন করে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের ১২ লাখ শেয়ার ইস্যু করা হয়। একই দিনে পারভেজ তমাল ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬১৭টি, আদনান ৩ লাখ ১১ হাজার ৫৩৯টি ও আরজু ৬ লাখ ১১ হাজার ৫৩৯টি করে শেয়ার নতুন করে বরাদ্দ নেন। এতে করে ওই তিনজন ও তাদের মালিকানাধীন এ অ্যান্ড পি ভেঞ্চার লিমিটেড তাদেরই আরেক জনবল ও গাড়ী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কোম্পানি এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের ৪৫ দশমিক ৯৪ শতাংশের শেয়ারের মালিক হয়ে যায়। এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের সংঘবিধির বিদ্যমান নিয়মানুসারে শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়ার নিয়ম অনুসৃত হয়েছিল কি-না সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। এই শেয়ার কী প্রক্রিয়ায় এই তিন ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বা এর বিপরীতে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের ব্যাংক একাউন্টে নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ জমার কোনো তথ্য বা রেকর্ড নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এফআইসিএসডি কর্তৃক পরিচালিত ২০২২ সালের বিশেষ পরিদর্শন ও অনুসন্ধান রিপোর্টে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যানের সিংহভাগ মালকানায় থাকা এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের সাথে ব্যাংকের একচেটিয়া ব্যবসা ও বিধিবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকের মুনাফা হ্রাসের বিষয়ে আপত্তি উল্লেখ করা হয়েছে। মুলত এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাজই হলো লোকবল নিয়োগ দেওয়া ও ব্যাংকের মালামাল ক্রয় বিক্রয় দেখাশোনা করা। জানাগেছে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারি নিয়োগ দিতে গিয়ে প্রত্যেক প্রার্থীর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঘুষ গ্রহণ করা হয়েছে। এভাবে প্রায় দশ হাজার লোক নিয়োগ দিয়ে কয়েক কোটি টাকার ঘুষ গ্রহণ করে এনআরবিসি ম্যনেজমেন্ট। এছাড়া মালামাল ক্রয়েও অতিরিক্ত মূল্য ধরা হয়েছে। তাই এই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হওয়া লাভজনক ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন তিনজন। এই অভিযোগ চাপা দিতে তড়িঘড়ি করে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের শেয়ার অন্যদের নামে হস্তান্তর দেখানো হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা ওই তিনজনের হাতেই রয়ে গেছে। কারণ, আদনান ইমাম তার নামে থাকা ৪ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার নিজের বাবা চৌধুরী ফজলে ইমামের নামে হস্তান্তর করেছেন। একইভাবে এ অ্যান্ড পি ভেঞ্চার লিমিটেডের সব শেয়ার স্টারলিংকস হোল্ডিংস লিমিটেডের নামে হস্তান্তর করা হয়। স্টারলিংক তাদেরই প্রতিষ্ঠান। তাই প্রকৃত মালিকানা এখনও আদনান ইমাম ও পারভেজ তমালের হাতেই রয়ে যায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড ও স্টারলিংকস হোল্ডিংস লিমিটেডের অফিস বনানীর সি ব্লকের ১১ নম্বর রোডের ৯৯ নং বাড়ি এডব্লিউআর এনআইবি টাওয়ারে অবস্থিত। এই বিল্ডিংয়ের ডেভেলপার ও মালিকানায় রয়েছে আদনান ইমামের এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড। অন্যদিকে পারভেজ তমাল তার মালিকানায় থাকা সব শেয়ার তারই ব্যবসায়ীক পার্টনার রিলায়বল বিল্ডার্স ও ইনাজ ক্যাফের মালিক শফিকুল আলমের নামে হস্তান্তর করেছেন।
তাছাড়া শফিকুল আলমকেই এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়েছে।
রফিকুল ইসলাম মিয়া আরজুর নামে থাকা ৭ লাখ ৫০ হাজার শেয়ার ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর নামে হস্তান্তর করলেও বিনিময়ে কোনো অর্থই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা পড়েনি। অর্থাৎ দলিলে নাম পরিবর্তন হলেও প্রকৃত সুবিধাভোগী আরজুই। মোহাম্মদ আলী চৌধুরী আরজুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও এনআরবিসি ব্যাংকের প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার। একসময় দুইবন্ধু রাশিয়ায় বসবাস ও ব্যবসা করতেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যমতে, গত বছর ৩১ অক্টোবরে এনআরবিসি ব্যাংকের স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার এবিএম আব্দুল মান্নানের বাজেয়াপ্ত ঘোষিত ৪ কোটি ৭০ লাখ ১ হাজার ৮৮৬ শেয়ারের (পরিশোধিত মূলধনের ৫.৬৭শতাংশ )মধ্যে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৫১১টি শেয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল ও এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমামের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে হস্তান্তর করা হয়। বাজেয়াপ্ত ঘোষিত এই শেয়ার হস্তান্তরে তাদের সহযোগিতা করেছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিভিশনের ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে পরিচালিত বিশেষ পরিদর্শনের তথ্যমতে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসান তার মামা এ বি এম আব্দুল মান্নানের ছদ্মাবরণে ওই শেয়ারের প্রকৃত মালিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে আহসান ও মান্নানের বেনামী শেয়ার ধারণ, তথ্য গোপন, নথি জালিয়াতি ও মানিলন্ডারিং প্রমাণিত হয়েছে।
প্রতিবেদনের সার্বিক পর্যবেক্ষণ ও মতামতের ক্রমিক নং ৬ এ উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- ” মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান জনাব শহীদুল আহসান ও আহসান গ্রুপের কর্মকর্তা জনাব মোঃ ওমর ফারুকের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালক জনাব কামরুন নাহার সাখী ও জনাব এবিএম আব্দুল মান্নান এর নামে তাদের ব্যাংক হিসাব খোলা ও পরিচালনা করা, তাদের বিকল্প পরিচালক হিসেবে আহসান গ্রুপের দুই জন পরিচালক/উপদেষ্টাকে নিয়োগ প্রদান, জনাব কামরুন নাহার সাখীর প্রক্সি হিসেবে ব্যাংকের সাধারণ সভায় শহীদুল আহসানের অংশ গ্রহন, এনআরবিসি ব্যাংকের বোর্ড সভায় শহীদুল আহসানের উপস্থিতি, জনাব শহীদুল আহসান কর্তৃক বিধিবহির্ভূতভাবে এনআরবিসি ব্যাংক হতে নামে/বেনামে বিপুল অংকের ঋণ গ্রহণ, জনাব মান্নান ও সাখীর শেয়ারের বিপরীতে প্রাপ্ত লভ্যাংশের প্রকৃত সুবিধাভোগী জনাব শহীদুল আহসান ও আহসান গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় প্রতীয়মান হয় যে, জনাব কামরুন নাহার সাখী ও জনাব এবিএম আব্দুল মান্নান এর নামে ছদ্মাবরণে ক্রয়কৃত সকল শেয়ারের (১৩.৩০+৩০.৪১=৪৩.৭১ কোটি টাকা) প্রকৃত মালিক মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যান জনাব শহীদুল আহসান যা ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (সংশোধিত ২০১৩) এর ১৪ক(২) ধারার লংঘন ও ১৪ক(৩) ধারা অনুযাযী উক্ত শেয়ারসমূহ বাজেয়াপ্ত হওয়ার যোগ্য।”
কিন্তু বাজেয়াপ্ত ঘোষনার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে গোপন করে ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল, এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমাম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম আউলিয়ার পরিকল্পনা ও তৎপরতায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে বিশেষ বিবেচনায় বাজেয়াপ্ত ঘোষিত শেয়ার ব্লক মার্কেটে ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমোদন জারি করা হয়েছে। এ অনুমোদন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
২০২১ সালের মার্চে আইপিওতে আসায়, বর্তমানে এনআরবিসি ব্যাংকের স্পন্সরদের শেয়ার লক-ইন (সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন বন্ধ) অবস্থায় রয়েছে, যার মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের মার্চে। তাছাড়া ২০২১ ও ২০২২ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বোনাস শেয়ারের লক-ইনের মেয়াদ যথাক্রমে ২০২৫ ও ২০২৬ সালের জুলাই পর্যন্ত। কিন্তু বিএসইসি বাজেয়াপ্ত ঘোষিত এই শেয়ারের লক-ইন পিরিয়ড বা সময়সীমাকে বিবেচনায় না নিয়েই বিশেষ বিবেচনায় ব্লক মার্কেটে ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমোদন দিয়েছে। অথচ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও স্পন্সর ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী ও স্পন্সর আবুল এম ইব্রাহিমের শেয়ার একইভাবে লক-ইন সময়ে হস্তান্তর বা ক্রয়-বিক্রয়ের আবেদন অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
বিএসইসির অনুমোদন নিয়ে গত ৩১ অক্টোবর ব্লক মার্কেটে বাজেয়াপ্তযোগ্য ওই ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ৫১১টি শেয়ার হস্তান্তর সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের ব্যবসায়িক অংশীদার শফিকুল আলম মিথুনের অনুকূলে ১ কোটি ৬৫ লাখ ৭২ হাজার ৯৯২টি, এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমামের স্ত্রী নাদিয়া মোমিন ইমামের অনুকূলে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৪৫ হাজার ৯০৪টি ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসানের মেয়ে রেহনুমা আহসানের অনুকূলে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ৬১৫টি শেয়ার ব্লক মার্কেটে বিক্রয়সূত্রে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বেনামী শেয়ার ক্রয় ও মানিলন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ ধামাচাপা দিতেই এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল ও এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান আদনান ইমামের সাথে আপোষ করে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল আহসান সুকৌশলে আব্দুল মান্নানের নামে থাকা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাজেয়াপ্তযোগ্য শেয়ার তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনুকূলে হস্তান্তরের সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। ফলশ্রুতিতে শেয়ারের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে রয়ে গেলো কিন্তু চিহ্নিত বাজেয়াপ্তযোগ্য শেয়ার আর বাজেয়াপ্ত করার সুযোগ থাকলো না। বাজেয়াপ্ত ঘোষিত শেয়ার হস্তান্তরের পরিকল্পিত অনিয়ম সামনে আসায় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আলোচনায় উঠে এসেছে যে, বাজেয়াপ্ত ঘোষিত শেয়ারের বিষয় গোপন করে শেয়ারগুলো বিক্রয়ের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংকৃত অর্থ সরিয়ে নিতেই কি এই শেয়ার আইপিও তে আনা হয়েছে? কেননা আইপিও অনুমোদনের সময়েও বাজেয়াপ্ত ঘোষিত শেয়ারের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রেখে অনুমোদনের আবেদন করা হয়েছিল।
বর্তমানে এবিএম আব্দুল মান্নান যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন এবং দীর্ঘদিন দেশে যাতায়াত করেন না । তা সত্ত্বেও, তিনি কিভাবে শেয়ার ট্রান্সফার সংক্রান্ত ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করেছেন তা বোধগম্য নয়। অপরদিকে, রেহনুমা আহসানের নামে যে শেয়ার ট্রান্সফার হয়েছে, তার বিপরীতে কোনো অর্থ লেনদেন হয়নি।
বাজেয়াপ্তযোগ্য শেয়ার কি ভাবে আইপিওতে আনা হলো জানাতে চাইলেবিএসইসির নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিমদ্য রিপোর্টকে বলেন, সব কোম্পানির প্রসপেক্টাসের উল্লেখিত শেয়ারের ভিত্তিতেই আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হয় । কোনো শেয়ার প্রসপেকটাসে উল্লেখ না থাকলে তার অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বাজেয়াপ্ত ঘোষিত শেয়ারের বিষয়টি প্রসপেক্টাসের উল্লেখ্য না করলে বিএসইসি জানতে পারে না।
লক ইন ঘোষিত (নির্দিষ্ট মেয়াদের আগে বিক্রি বন্ধ) শেয়ার কিভাবে সময় শেষ হওয়ার আগেই ব্লক মার্কেটে বিক্রির অনুমোদন দিলো বিএসইসি জানতে চাইলে বিএসইসির এই পরিচালক বলেন, বিশেষ বিবেচনায় বিএসইসি এ ধরণের অনুমোদন দিতে পারে। তবে ঢালাও ভাবে দেওয়ার নিয়ম নেই। বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে এ ধরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন সেটা বলতে পারবো না। একই কোম্পানির কয়েকজন পরিচালককে অনুমোদন দেওয়া হলো,কয়েকজনকে দেওয়া হলো না- কারণ কি, জানতে চাইলে রেজাউল করিম বলেন, ওই যে বললাম ঢালাও ভাবে দেওযা হয় না।
এনআরবিসি ব্যাংকের ম্যনেজিং ডিরেক্টর গোলাম আউলিয়া মঙ্গলবাররাতে (২০ ফেব্রুয়ারি)দ্য রিপোর্টকেবলেন, এটা ব্যাংকের উদ্যেক্তা পরিচালকদের ইন্টারন্যাল ইস্যু। শেয়ার হস্তান্তরে কোন নিয়ম লংঘন হয়নি, কেননা সবকিছুই বাংলাদেশ ব্যাংকের ও বিএসইসির অনুমতি নিয়ে করা হয়েছে। এছাড়া এনআরবিসি ম্যানেজমেন্টের চ্যাপ্টার অনেক আগেই ক্লোজ করা হয়েছে। তিনি বলেন শেয়ার হস্তান্তর নিয়ে বিদিশে থাকা ব্যাংকের উদ্যেক্তা পরিচালকদের পক্ষ থেকেও আমার কাছে কিছু অভিযোগ এসেছে। আমি তাদের সেসব উত্তর দিয়েছি।
মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে এই ব্যাংকটির প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৩.৩০ থেকে ১৩.৭০ টাকা দরে। ৩ লাখ ৯১ হাজার ৬২৭ টি শেয়ার ৫০ লাখ ২৭ হাজার টাকায় লেনদেন হয়।বর্তমানে এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্যেক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার রয়েছে ৬৮ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকরীদের শেয়ার রয়েছে ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার রয়েছে ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২১ সালে এনআরবিসি ব্যাংক তালিকাভুক্ত হয়। এ ক্যাটাগোরিতে লেনদেন হওয়া কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০২২ সালে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ নগদ এবং ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ইস্যু করেছে। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ৮২৮ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৩৪০ টাকা।
(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/২০ ফেব্রুয়ারি,২০২৪)