মসজিদের দরজায় তালা কেন?
মাহি হাসান, দ্য রিপোর্ট: রফিক মোল্লা। বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলায়। ঢাকায় রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন প্রায় ১৫ বছর। সেগুনবাগিচায় নিজের রিকশায় বসে ঝিমুচ্ছিলেন। কড়া রোদ। তবুও রিকশায় বসেছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার অভ্যাস তাঁর। রাস্তার ধারে এক সাইড করে নামাজ পড়েছেন। তাঁর সাথে কথা হচ্ছিল দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদকের।
কথোপকথনের সময় আক্ষেপ করে বলছিলেন প্যাসেঞ্জার নিয়ে চলার সময় মাঝে-মধ্যেই জামাতের সহিত নামাজ পড়তে পারিনা। জামাতের ঘন্টাখানেক পরেই মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে দেখা যায় মসজিদগুলো তালা দেয়া। বেশির ভাগ মসজিদগুলোতেই এখন তালা দেওয়া থাকে। রোজার মাসে কিছু মসজিদ খোলা থাকলেও রোজা শেষ হতেই বেশিরভাগ মসজিদেঝুলে তালা। রফিক মোল্লা বলেন, আমি সেগুনবাগিচা, সিদ্ধেশরী, রামপুরা, খিলগাঁও এই এলাকাটায় রিকশা চালাই। এসব এলাকার মসজিদগুলো এখন বেশিরভাগ সময় তালা দেওয়া থাকে। নামাজের আধাঘন্টা আগে ও নামাজের সর্বোচ্চ এক ঘন্টা পরে বন্ধ করে দেওয়া মসজিদের দরজা।
বর্তমানেরাজধানীর অভিজাত এলাকার পাশাপাশি বাণিজ্যিক এলাকা প্রায় সব এলাকার মসজিদ একই অবস্থা। নামাজের সময় ব্যাতীত বেশিরবাগ মসজিদই বন্ধ পাওয়া যায়। রাজধানীর বড় বড় মসজিদগুলো অর্থ্যাৎ বনানী সেন্ট্রাল মসজিদ, গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদ ,মহাখালী গাউসুল আজম মসজিদ, কাকরাইল মসজিদ ছাড়া বেশিরভাগ মসজিদেই নামাজের ওয়াক্ত ছাড়া তালা চোখে পড়ে। রাজধানীর বনানী,গুলশান,বাড্ডা, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, সিদ্ধেশরী সহ একাধিক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটা এলাকার মসজিদই নামাজের সময় ছাড়া বন্ধ। মসজিদ কমিটির সদস্যরা বলছেন, পাঁচ-সাত বছর আগেও মসজিদ খোলা না থাকলেও অন্তত বারান্দা সারারাত খোলা থাকতো। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বারান্দায় থাকা জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। একাধিক মসজিদের ফ্যান প্রায় কয়েকবার চুরির হয়েছে বলে জানান মসজিদের মুয়াজ্জিনরা। তবে সাধারন মানুষ বলছে, মসজিদে কখনোই তালা মেরে রাখা উচিত নয়। অন্তত বারান্দা খোলা রাখা উচিত। রাজধানীর দক্ষিন বাড্ডা জামে মসজিদ, বাউতুন নূর জামে মসজিদ,বাউতুল আবরার জামে মসজিদ, খিলগাঁও তালতলা মসজিদ, আইউবাগ জামে মসজিদ,গণি মসজিদ, মগবাজার ওয়ারল্যাস জামে মসজিদসহ অসংখ্য মসজিদ জামাতের সময় ব্যতীত বন্ধ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে সানিম মাহবীর ফাহাদ নামে এক মুসুল্লি বলেন, "শহরের অধিকাংশ মসজিদগুলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় ছাড়া বাকি সময়গুলো তালাবন্ধ করে রাখা হয়। এর ফলে কেউ যদি ওয়াক্ত মিস করে ফেলে তাহলে মসজিদে বসে নামাজ পড়ার সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে। আমি এরকম পরিস্থিতিতে বহুবার পড়েছি। কিন্তু আল্লাহর ঘরকে এভাবে তালাবদ্ধ করার বিষয়টা আমার কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।"
সাধারন মানুষদের মধ্যেও এ ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কথা হয় অনিক ইসলাম নামে এক প্রাইভেট কোম্পানির চাকুরীজীবির সঙ্গে। তিনি বলেন, আসলে মসজিদ তো বন্ধ রাখার কিছু নয়। এটি কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। শুধু নামাজের জন্যই নয় মুসাফিরদের বিশ্রাম নেওয়ার জায়গাও মসজিদ। এছাড়া মুসাফিরদের ওয়াশরুম ব্যবহারের জায়গায় হিসেবে মসজিদের ওয়াশরুম ব্যবহার উপযোগী। ব্যবসায়ী ফয়সাল আহমেদের অফিস বাড্ডা এলাকায়। তিনি বলছিলেন,আমার অফিস বাড্ডা এলাকায়। ওয়াশরুম নেই। টয়লেট হিসেবে আমার স্টাফরা ব্যবহার করতো পাশের মসজিদের ওয়াশরুম। এখন গত তিন-চার বছর ধরে দেখছি বন্ধ থাকছে মসজিদ। রাজধানীর রামপুরা এলাকার জমজম মসজিদের এক মুসুল্লি বলছিলেন, বর্তমানে রমজান মাস থাকায় অনেক মসজিদ এখন খোলা থাকে সারাদিন। যেকোন মানুষ যেকোন সময় নামাজ পড়তে পারে। কোরআন তেলওয়াত করতে পারে। প্রয়োজনে বিশ্রাম করতে পারে। এমন বারো মাস থাকা উচিত। এ ব্যাপারে রাজধানীর দারুল উলুম মসজিদ মাদ্রাসার মুয়াজ্জিন মাহবুব ইসলাম বলেন, আসলে আগে মসজিদ খোলা থাকতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেক বার মসজিদের জিনিসপত্র চুরি হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে কি করার আছে?
বিশিষ্ট লেখক ও শিশু গবেষক ড. সালেহ মতিন বলেন, "বিশ্বের আর কোথাও এমন নজির আছে কি না আমার জানা নেই যে, মসজিদে জামাতের নির্ধারিত সময়ের আগে পিছে কিছু সময় ব্যতীত বাকী সময়টা মসজিদ তালাবদ্ধ রাখা হয়। এমনকি আপনি কোন মসজিদে জামাতের নির্ধারিত সময়ের ১০/১৫ মিনিট পরে উপস্থিত হয়ে একাই ফরয পড়ে নিতে বাধ্য হলেন। হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন নামাজের শেষের দিকে আপনার পাশে কেউ আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনি সালাম ফিরায়ে নামাজ শেষ করতেই তিনি আপনাকে বলবেন, সুন্নাত বাইরে পড়েন, মসজিদে তালা দিব। এ আচরণ রীতিমতো দৃষ্টিকটূ, অন্যায় এবং ইসলামী সংস্কৃতির পক্ষে আত্মঘাতী। মসজিদে তালা ঝুলিয়ে মুসল্লীদের স্বাভাবিক ইবাদাত কর্মকে ব্যাহত করা উচিত নয়"। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ইসলামিক ব্যাক্তীত্ব মুফতি আব্দুল্লাহ নূর বলেন, "কোনো কোনো মসজিদে দেখা যায়, জামাত শেষ করার সামান্য পরেই মসজিদের মুয়াজ্জিন বা খাদেমরা মসজিদে অবস্থানরত মুসল্লিদের বের হয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিতে থাকেন, যা কিছুতেই সমীচীন নয়। আর যেখানে নামাজের নির্ধারিত সময় ছাড়া অন্য সময়ও ইবাদত ও দ্বিনি তালিমের উদ্দেশ্যে মুসল্লিদের মসজিদে ব্যাপক আসা-যাওয়া থাকে ওই সব মসজিদ খোলা রাখার ব্যবস্থা করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এ জন্য প্রয়োজনে মালামাল সংরক্ষণ করা ও মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য অতিরিক্ত খাদেম নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরো মসজিদ খোলা রাখা সম্ভব না হলে অন্তত মসজিদের বারান্দা খোলা রাখার ব্যবস্থা করা আবশ্যক।"
বায়তুল মোকারম মসজিদ মুসুল্লি কমিটির সভাপতি ইয়াকুব আলী বলেন, মসজিদ অবশ্যই খোলা রাখা উচিত। কিন্ত নিরাপত্তার কথা ভেবে এলাকার স্থানীয় মসজিদগুলো সম্পূর্ণ খোলা রাখা হয়তো সম্ভব হয়না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মসজিদ খোলা থাকে।
(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/মাহা/১৯শে মার্চ দুইহাজার চব্বিশ)