সময়ের ঘোড়দৌড় ও একজন সাদা শ্রমিক
মীর ইয়ামীন যায়ীম: সারাদিন অফিস করে আড়াই ঘন্টা জ্যাম ঠেলে যখন বাসায় পৌঁছুলাম তখন রাত প্রায় পৌনে নয়টা। ঠিক তখনই অফিসের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো । একটা নোটিফিকেশন দেখতে পেলাম, মিটিং এর ই-মেইল এসেছে | সেদিনই রাত সাড়ে নয়টায়, অর্থাৎ ৪৫ মিনিট পরেই মিটিং, তাও আবার আধা ঘন্টার মিটিং না, এক ঘন্টার মিটিং। সামনে একটি প্রজেক্ট ডেলিভারি আছে তাই মিটিং কল করা হয়। তাই গ্রুপের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই তাই এই ইমেইলটি যায় । মিটিং এর মধ্যে আমার কাছে ইনস্ট্রাকশন আসলো যে আমাদের যে বিদেশি প্রজেক্ট কনসালটেন্ট আছে, তার সাথে কো-অর্ডিনেট করতে হবে। মিটিং শেষ সবাই মিটিং থেকে বের হয়ে গেল। আমি ভাত খেতে বসলাম ।
রাত চারটায় হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো, তাও আবার অফিসের ফোন । একটা অপরিচিত বিদেশী নাম্বার। ফোনটা ধরেই বুঝতে পারলাম আমার কনসালটেন্ট ফোন করেছে। তার ইংলিশ কথাগুলো আমার কাছে হিব্রু ভাষার মতো শুনতে লাগছিল। কথা শেষ করে ফোনটা রেখে দিলাম। আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ কানের পাশে অনেক জোরে বেল বেজে উঠলো। এক চোখ খুলে দেখি সকাল ৬ টা বাজে। অফিস যাওয়ার সময় হয়েছে। সোয়া সাতটার মধ্যে যদি বের না হতে পারি তাহলে কখনোই সকাল নয়টার মধ্যে অফিসে ঢুকতে পারবো না। তাই মেজাজ খারাপ করে উঠে পড়লাম। প্রতিদিন ঢাকায় ট্রাফিক জ্যাম বেড়ে যাচ্ছে। সেদিন অফিসে ঢুকতে ঢুকতে প্রায় নয়টা বিশ বেজে গেল।
তাড়াতাড়ি করে ইনস্ট্রাকশন অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করে দিলাম। কাজ করতে করতে হঠাৎ আবার ইমেইল পেলাম। মিটিং কল করেছে। কিভাবে যে সময় চলে যেতে থাকলো বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ করে ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। দুপুর ২ টা বাজে। ক্যাফেটেরিয়াতে এডমিন অফিসারের সাথে দেখা হল। এডমিন কথার কৌশলে আমাকে মনে করিয়ে দিল যে আমি অফিসে লেট করেছি। তার কথা শুনে মনটা কেন যেন ছোট হয়ে গেল। কোনমতে খাওয়া শেষ করে আবার কাজে বসে পড়লাম।
খুকুর খুক করে মাইকে একজন মানুষ কেশে উঠল। মুয়াজ্জিন মাইক ঠিক করছে আসরের আজান দেওয়ার জন্য। পাশ থেকে আমার কলিগ চেয়ার ছেড়ে উঠে চা খেতে গেলো, সিগারেটের প্যাকেট নিতে ভুলল না। আর আমি সেই গাধার মত কাজই করতে থাকলাম কারণ সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে ক্লাইন্টকে একটা ফাস্ট ড্রাফট পেপার ইমেইল করতে হবে ।
হঠাৎ বস ফোন করল। কেন ইমেইলটা পাঠাচ্ছি না,জিজ্ঞেস করল। এর সাথে নতুন ইনস্ট্রাকশন দিল প্রজেক্ট কনসালট্যান্টকে সিসি এবং বসকে বিসিসি করতে। ঘড়িতে তখন ছয়টা দশ ।মনে হচ্ছিল ঘড়ির সময় যেন ঘোড়দৌড়ের ট্র্যাকে চলছে | তাড়াতাড়ি করে ইমেইল করে দিলাম আর ব্যাগ গোছানো শুরু করলাম। লিফটের সামনে যেতে মাগরিবের আজানের শব্দ পেলাম ।
দীর্ঘ সময় নিচে দাঁড়িয়ে থাকার পরে একটি সিএনজি পেলাম যেটা আমার বাসার দিকে যেতে রাজি হল। তাও আবার রেগুলার ভাড়ার থেকে প্রায় ১০০ টাকা বেশি। সারাদিন পর নিজের ফোনের দিকে তাকালাম। বাসা থেকে ফোন কলটা এসেছিল, ধরতে পারিনি । ফোনে টেক্সট মেসেজ ওপেন করে দেখি মা মেসেজ করেছেন। টেক্সট মেসেজে লেখা "বাবা আজকে টাকা নিয়ে আসিস বাসা ভাড়া দিতে হবে" । ব্যাংকে কোন টাকা নেই, কারণ এখনও ফুল বেতনটা পাই নাই ফিফটি পার্সেন্ট বেতন দিয়েছিল, তাও ১০ দিন আগে।
মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল ।
আমি ভাবতে থাকি যে কোভিডের পর সবকিছু বদলে দিয়েছে। অফিসে চাকরির ধরন চেঞ্জ হয়ে গেছে | নরমাল মোড টু হাইব্রিড মোড। কিন্তু এই হাইব্রিড মোড আশাতে এখন প্রায় নয় ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টা কাজ করতে হয়। যা নিয়মিত ঘন্টার চেয়ে বেশি।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এক্সট্রা আওয়ার্স এর জন্য অফিস কিন্তু আমাকে এক্সট্রা টাকা দেয় না । এই চাকরিটা নেওয়ার সময় প্রতি সপ্তাহে চল্লিশ ঘন্টা কাজ করার পলিসি ছিল, তাও আবার বোল্ড লেটারে লেখা। কিন্তু আসলেই কি আমরা ৪০ ঘন্টা কাজ করি নাকি বেশি করি? আমাদের অবস্থা ডেইলি লেবারের চেয়েও খারাপ। এসব চিন্তা করতে করতে চোখ লেগে গেল, ঘুমিয়ে পড়লাম। "মামা উঠেন বাসায় চইলা আইছি" সিএনজি ওয়ালা ডাক দিল। ঘড়িতে আটটা চল্লিশ বাজে । ঘরের দরজার সামনে যেতে অফিসের ফোনটা আবার বেজে উঠলো। তার মানে নতুন কাজ এসেছে। আবার কাজে লাফ দিয়ে পড়তে হবে।