দুর্ঘটনায় নিহত লিটনের জীবনের দাম কী ৬০,০০০ টাকা ?
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: রমযানের ঈদের ছয়দিন পর গত ১৭ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মোহাম্মদ লিটন। সেদিনই তার পরিবারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।
রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ির যে ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতেন সেই বাড়িওয়ালা এপ্রিল মাসের ভাড়াটা মওকুফ করেছেন। কিন্তু কতোদিন ছাড় দেবেন বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া? এরি মধ্যে ঘরে চাল ডাল তেল নুন সবজির বাড় বাড়ন্ত। প্রতিবেশী স্বজনরা প্রথম প্রথম খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। কেউ কেউ বাজারের সমস্যার সমাধানও করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আস্তে আস্তে লিটনের বাড়ির দিকে পা মাড়ানো কমছে সবার। এদিকে লিটনের এইচ এস সি পরীক্ষার্থী মেয়ের রেজিস্ট্রেশন ফি কয়েকজন সজ্বন মিলে মেটালেও সামনের দিনগুলোতে কি হবে? লিটনের ক্লাস নাইন পড়ুয়া ছেলের ভবিষ্যত কি ? পড়ালেখা কি চালিয়ে যেতে পারবে সে ? এসব প্রশ্নই এখন পরিবারটির সামনে।
যে গাড়ির সুপাইরভাইজার ছিলেন লিটন সেই সেন্টমার্টিন দ্বীপ পরিবহনের মালিক মোহম্মদ রানা এসেছিলেন গত ২৩ এপ্রিল লিটনের বাসায়। এসেই লিটনের নানা দোষ খুঁজে খুঁজে বের করছিলেন। ওই দিনের ক্যাশ বাবদ লিটনের কাছে থাকা ৩৭ হাজার টাকার জন্য যেন তার বুক ফেটে যাচ্ছিল। যে গাড়ির জন্য জীবন গেল সেই গাড়ির পেছনে কত খরচ হয়েছিল তার ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন। গাড়ির যে ড্রাইভার , যাকে দিয়ে নির্ঘুম গাড়ি চালাতে বাধ্য করছিলেন, চট্টগ্রাম থেকে গাড়ি নিয়ে সেই রাতে ঢাকায় ফিরতে বাধ্য করছিলেন, যিনি আগের রাতেও নির্ঘুম গাড়ি চালিয়েছেন, এসব নিয়ে কথা নেই, রা নেই পলাতক ড্রাইভার নিয়েও। আর পলাতক মানেই যেন মালিকের রক্ষা কবচ।
২৩ এপ্রিল যাত্রাবাড়িতে লিটনের ভাড়া বাসায় বসে অনেক মানুষের সামনে লিটনের জীবনের মূল্য মাত্র ৬০ হাজার টাকা ধার্য করে দেন রানা। ক্ষতিপূরণ বাবদ মাত্র ৬০ হাজার টাকা! লিটনের স্ত্রী রোকসানা রেখা মালিক রানার এ আপোষ প্রস্তাব সেদিন ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দেন। এরপর আর কোন যোগাযোগ করেন নি রানা। জানা গেছে এরপর থেকে গাড়ির মালিক পক্ষ চৌদ্দগ্রাম থানা থেকে গাড়ি ছাড়ানোর দেন দরবার করে চলেছেন। গত ১৭ এপ্রিল রাত চার টার দিকে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার বাশেরকুল নামক স্থানে জোনাকী হোটেলের সামনে সেন্টমার্টিন পরিবহনের বাস ( ঢাকা মেট্রো ব-১১-৬১৭৫) দূর্ঘটনায় পড়ে দুমড়ে মুচড়ে যায়। পেছন থেকে গিয়ে সামনের একটি গাড়িকে সজোরে ধাক্কা দেয় বাসটি। বাসের ড্রাইভার পালিয়ে যান। এসময় বাসের সুপারভাইজার লিটন সহ প্রায় ৮ জন গুরুতর আহত হন। হাইওয়ে পুলিশ আহতদের নিকটবর্তী চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। গুরুতর আহতদের সেখান থেকে কুমিল্লা ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এ ঘটনায় মিয়াবাজার হাইওয়ে পুলিশ বাদি হয়ে চৌদ্দগ্রাম থানায় ২০১৮ সালের ৯৮/১০৫ ধারায় এজাহার করে। দুর্ঘটনার শিকার গাড়িটি পুলিশ জব্দ করে থানায় নিয়ে যায়। কুমিল্লার কোতয়ালী মডেল থানা সূত্রে জানা যায়, দূর্ঘটনার পর সেন্টমার্টিন পরিবহনের সুপার ভাইজার মো. লিটন (৫০)কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সুরতহাল রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দূর্ঘটনায় মাথায় ও বুকের বামপাশে আঘাত পাওয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মো. লিটনের মৃত্যু ঘটে। এদিকে লিটনের মৃত্যু সংবাদের যাত্রাবাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। লিটনের বাড়িতে মাতম ওঠে। সেই মাতম এখনও চলছে। একমাত্র আয় রোজগারের মানুষটা চলে যাওয়ায় এক অকুল সাগরে পড়েছে পরিবারটি। সদস্যরা প্রতিদিন লড়াই করছে ক্ষুধার সঙ্গে। লেখাপড়া বাড়িভাড়াতো পরের হিসেব।
এ বিষয়ে কথা হয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের সঙ্গে তিনি বলেন, মামলাটি তদন্তাধীন। আসামি ধরার চেষ্টা চলছে। লিটনের সদ্য বিধবা স্ত্রী রোখসানা রেখা বলেন, " আমি এখন অথৈ সাগরে পড়ে গেছি। কি করবো কিভাবে সংসার চালাবো জানিনা। বাসের মালিক রানা সাহেব একদিন বাসায় এসে আপোষ প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি মাত্র ৬০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছেন। একজন মানুষের জীবনের দাম কি ৬০ হাজার টাকা?" প্রশ্ন করেন রেখা ।
(দ্য রিপোর্ট/ টিআইএম/৬ মে/ ২০২৪)