জাতিসংঘের কালো তালিকায় ইসরায়েলের সেনাবাহিনী
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: জাতিসংঘ গত মাসে জানায়, হামাস শাসিত ফিলিস্তিনের গাজায় আট মাসের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে কমপক্ষে ৭ হাজার ৭৯৭ শিশু নিহত হয়েছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের সর্বশেষ তথ্যমতে, ১৫ হাজার ৫০০ শিশু নিহত হয়েছে।
শিশুদের ওপর সহিংসতাচালায় এমন বৈশ্বিক অপরাধীদের কালো তালিকায় ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করেছে জাতিসংঘ। গতকাল শুক্রবার এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ আরদান। শনিবার (৮ জুন) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ আরদান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে জাতিসংঘের এই পদক্ষেপকে ‘লজ্জাজনক’বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি লজ্জাজনক সিদ্ধান্ত। আমাদের সেনাবাহিনী হলো বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিকতাসম্পন্ন বাহিনী। এক ব্যক্তিই কালো তালিকাভুক্ত করেছেন। তিনি হলেন জাতিসংঘের মহাসচিব। তিনি সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত করছেন। তিনি ইসরায়েলের প্রতি ঘৃণায় পরিচালিত।’
ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত জানান, শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
‘চিল্ড্রেন ইন আর্মড কনফ্লিক্ট’ নামক একটি প্রতিবেদনে বিশ্ব তালিকাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আগামী ১৪ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কূটনৈতিক সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, হামাস ও ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদকেও কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
শিশুদের বিরুদ্ধে ৬টি অপরাধের প্রেক্ষাপটে কালো তালিকাভুক্ত করে থাকে জাতিসংঘ। যার মধ্যে রয়েছে- হত্যা ও পঙ্গু করা, যৌন সহিংসতা, অপহরণ, যুদ্ধে শিশুদের নিয়োগ ও ব্যবহার, সাহায্যের সুবিধা অস্বীকার এবং স্কুল ও হাসপাতালে আক্রমণ। ইসরায়েল, হামাস বা ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদকে, কী লঙ্ঘনের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত, জাতিসংঘের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কের জন্য খারাপ পরিণতি বয়ে আনবে।’ ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘের বৈরী সম্পর্ক রয়েছে, যা গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের সময় আরও খারাপ হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জানিয়েছেন, জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে ফোন করেকালো তালিকাভুক্তির বিষয়টি অবহিত করেছেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত গিলাদ আরদান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘আমি জাতিসংঘমহাসচিবের এই লজ্জাজনক সিদ্ধান্তে সম্পূর্ণভাবে হতবাক ও বিরক্ত। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিক সেনাবাহিনী, তাই এই অনৈতিক সিদ্ধান্ত কেবল সন্ত্রাসীদের সাহায্য করবে ও হামাসকে পুরস্কৃত করবে।’
আংশিক প্রকাশিত প্রতিবেদনটিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ অ্যাখ্যা দিয়ে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আরও লিখেছেন, ‘আমি আমার ২৪ বছরের ক্যারিয়ারে সংস্থাটিকে (জাতিসংঘ) সেবা করতে দেখিনি।’
জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি ভার্জিনিয়া গাম্বা ‘চিল্ড্রেন ইন আর্মড কনফ্লিক্ট’ প্রতিবেদনটি সংকলন করেছেন। প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত তালিকার লক্ষ্য- শিশুদের সুরক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ দলগুলোকে লজ্জা দেওয়া। বিশ্ব তালিকাটি দুটি ভাগে বিভক্ত: যে দলগুলো শিশুদের সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে এবং যে দলগুলো ব্যবস্থা নেয়নি।
জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত গিলাদ আরদান বলেন, ‘শুক্রবার তাকে জানানো হয়- ইসরায়েলকে সেই দলগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যারা শিশুদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।’
এদিকে এর প্রতিক্রিয়ায়ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘হামাসকে সমর্থন করে জাতিসংঘ নিজেকে ইতিহাসের কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।’
গত বছরের ৭ অক্টোবরেহামাসের হামলার জবাবে গাজায় প্রতিশোধমূলক হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। তেল আবিবের দাবি, ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের বেশি ইসরায়েলি নিহত হয়। এছাড়া ২৫০ জনেরও বেশি মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস।
এদিকে গাজায় চলমান ইসরায়েলিআগ্রাসন ও বোমাবর্ষণে গত ২৪ ঘণ্টায় ৭৭ জনসহ এখন পর্যন্ত ৩৬ হাজার ৭৩১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে বলে শুক্রবার সর্বশেষ আপডেটে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও হাজার হাজার মানুষ চাপা পড়ে রয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ৮ মাসের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের হামলায় গাজার ২৩ লাখ মানুষের অধিকাংশই বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘জাতিসংঘের সিদ্ধান্তটি ইসরায়েলকে তার অপরাধের জবাবদিহিতা করার পথে সঠিক একটি পদক্ষেপ। ইসরায়েলকে অনেক আগেই কালো তালিকায় যুক্ত করা উচিত ছিল।’
শিশুদের ওপর হামলা ও সশস্ত্র সংঘাতের কারণে জাতিসংঘের বিশেষ দূত গাজায় ২০১৪ সালের যুদ্ধের সময় ইসরায়েল ও হামাসকে কালো তালিকাভূক্তির সুপারিশ করার ৯ বছর পর এবার পদক্ষেপটি নিলো জাতিসংঘ। ২০১৪ সালে ২ হাজার ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহতহয়। নিহতদের মধ্যে ৫৪০ শিশু ছিল।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েল তৎকালীন জাতিসংঘের প্রধান বান কি মুনের কালো তালিকা থেকে দূরে থাকার জন্য তদবির করেছিল। যদিও জাতিসংঘ ইসরায়েলি চাপের বিষয়টি অস্বীকার করেছিল। শেষ পর্যন্ত, বান কি মুন ইসরায়েল বা হামাসকে অপরাধীদের তালিকায় যুক্ত করেনি। যদিও প্রতিবেদনে ৫০ দিনের সংঘাতের জন্য ইসরায়েলের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছিল।
ইউক্রেনে শিশুদের হত্যা ও পঙ্গুত্ব, স্কুল ও হাসপাতালে হামলা, শিশুদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য গত বছর রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীকে কালো তালিকায় যুক্ত করে জাতিসংঘ। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে হামলার পর থেকে রাশিয়া বেসামরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার কথা অস্বীকার করে আসছে।