১০৪ তম বছরে পা রাখলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১৯২১ সালের এই দিনে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটে এই প্রতিষ্ঠানের। তৎকালীন ব্রিটিশশাসিত বাংলায় এটিই ছিল একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পশ্চাৎপদ এ অঞ্চলের মানুষকে শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে নিতে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুর দিকের কার্যক্রম বিশ্বজুড়ে সুনাম কুড়ালেও বিগত কয়েক দশক ধরে শিক্ষার্থীদের তীব্র আবাসন সংকট, গবেষণার অপ্রতুলতা এবং অ্যানালগ সেবার কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে গত বছর অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। এদিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিবিড় চর্চার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনবদ্য অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন উপাচার্য মাকসুদ কামাল। অভিনন্দন জানিয়েছেন বর্তমান ও সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে। তিনি বলেন, জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের গৌরবগাথা নিয়ে শতবর্ষ পাড়ি দিয়েছে প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চিরগৌরবময় মুক্তিযুদ্ধসহ গণমানুষের সব লড়াইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা নেতৃত্ব দিয়েছে।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা জানান, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত মান বজায় রাখার কারণেই প্রতিষ্ঠানটি অভিধা পেয়েছে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’। পাশাপাশি এটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দায়িত্বও পালন করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি চালুর ২৬ বছরের মধ্যে ব্রিটিশদের কবল থেকে উপমহাদেশ মুক্ত হয়। সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্র। সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। পাকিস্তান সৃষ্টির পরের বছর থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র জাতিসত্তা সৃষ্টির আন্দোলনে নিবেদিত হয়। এক কথায় বলতে গেলে, দেশ স্বাধীন এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ গঠন ও পরিচালনায় যারা ভূমিকা রেখেছে তাদের ৫০ বছর ধরে তৈরি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তৎকালীন সময়ে ঢাকায় সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকা ছিল রমনা। ওই এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছিল এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালে তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ ছিল। একটি পরিপূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে এর যাত্রা শুরু হয়। আবাসিক হল ছিল-সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা হল-যা এখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল ও জগন্নাথ হল। প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক ছিলেন মাত্র ৬০ জন। আর শতবর্ষ পরে এই বিশ্ববিদ্যালয় মহিরুহে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে অনুষদ ১৩টি, বিভাগ ৮৩টি, ইনস্টিটিউট ১২টি, গবেষণা ব্যুরো ও কেন্দ্র ৫৬টি। আবাসিক হল ২০ এবং হোস্টেল ৩টি। আর শিক্ষার্থী ৩৭ হাজার ১৮ জন ও শিক্ষক ২০০৮ জন। কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৪ হাজার ৪৫৫ জন। সম্প্রতি ডিবিএ (ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) ডিগ্রিও প্রদান করা হচ্ছে। তবে ৬০০ একরের ক্যাম্পাস যাত্রা করলেও বর্তমানে এর পরিধি ২৭৫ দশমিক ৮৩ একর। সম্প্রতি সরকার পূর্বাচলে ৫১.৯৯ একর জমি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ দিয়েছে। কৃতী শিক্ষার্থীদের মেডেল, বৃত্তি ও সম্মাননা দিতে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে ট্রাস্ট ফান্ড আছে ৩৪৭টি।
বর্তমানে অপ্রতুল বাজেটের বিপরীতে সক্ষমতার অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তিসহ নানা সংকট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি একাডেমিক দিক থেকেও পিছিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষার্থীরা আবাসন সংকট নিয়েই দিন কাটাচ্ছে। মান্ধাতা আমলের শ্রেণিকক্ষে চলছে ক্লাস। গবেষণাগারের অবস্থাও একই। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরনের সেবাও আধুনিক নয়। আবাসিক হল ও ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে শিক্ষার্থীরা শারীরিক-মানসিক সংকটে পড়ছে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে চলছে ভাটা। শিক্ষকদের একটি অংশের নিয়মিত ক্লাস না নেওয়া এবং একাডেমিক কার্যক্রমের পরিবর্তে রাজনৈতিক ও ভিন্নদিকে মনোনিবেশ বেশি থাকার অভিযোগও আছে।
তবে গত বছর অধ্যাপক মাকসুদ কামাল উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয় করেছে গবেষণা মেলা ও ইনোভেশন মেলা। শিক্ষকদের জন্য প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় প্রশিক্ষণের। শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট সমাধানে আবাসিক শিক্ষার্থীদের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়। আবাসিক হল বহিরাগত ও অবৈধ ছাত্র মুক্ত করতে হলের প্রবেশদ্বারে ই-গেট বসানোর ঘোষণা দিয়েছেন উপাচার্য। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মার্ট কার্ড পাঞ্চ করে প্রবেশ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করেছেন বৃত্তি। ফলে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় চমক দেখিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান ৫৫৪তম।
জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক শিক্ষাবিদ এম তারিক আহসান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগের চেয়ে অনেক উন্নতি করেছে। যার প্রমাণ গ্লোবাল র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হচ্ছে জ্ঞান উৎপাদন করা। আর এ জন্য প্রয়োজন গবেষণা। অন্যদিকে গবেষণা বৃদ্ধির জন্য বাড়াতে হবে বরাদ্দ। এবারের বাজেটে বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে। এটা আরও বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, আমরা চাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হোক। আমাদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব রাখেন। ফলে আশা করি আরও নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে আমরা আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণ করতে পারব।
আজকের আয়োজন : এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য-‘তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা’। উপাচার্য মাকসুদ কামাল আজ সকাল ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সামনে পায়রা চত্বরে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন।
কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল ও হোস্টেল থেকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা শোভাযাত্রা নিয়ে স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে সমবেত হবেন। সেখান থেকে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে উপাচার্য মাকসুদ কামালের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অ্যালামনাই, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নিয়ে পায়রা চত্বরে যাবেন। সেখানে জাতীয় পতাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোর পতাকা উত্তোলন, পায়রা, বেলুন ও ফেস্টুন উড়ানো, কেক কাটা এবং সংগীত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিম সং ও উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশিত হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের প্রতিপাদ্য ‘তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা’ বিষয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনা সভার শুরুতে দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ‘স্মরণিকা’ ও ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ শীর্ষক গ্রন্থের ২য় খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন করা হবে।