দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: সম্পত্তিতে হিন্দু ও বৌদ্ধ নারীদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন জাতীয় সংসদের উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি। আজ (১৫-০৭-২০২৪ সোমবার) বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের নেতৃবৃন্দ সংসদ উপনেতার সঙ্গে দেখা করে ১১-দফা দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি হস্তান্তর করার সময় তিনি একথা বলেন।

 

সংস্কার পরিষদের নেতৃবৃন্দ হিন্দু আইনের আওতাধীন নারী,লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠি,প্রতিবন্ধী এবং দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের অধিকার প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা তুলে ধরে আইন সংশোধনের জন্য সংসদ উপনেতার সহায়তা চাইলে তিনি বলেন, “আমি বিষয়টি নিয়ে নেত্রীর সঙ্গে কথা বলব।”

দাবির ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা স্বীকার করে তিনি বলেন, “তবে আপনাদেরকে লেগে থাকতে হবে;সমাজের মানুষকে বোঝাতে হবে,জাগাতে হবে।”

হিন্দু আইন সংস্কারের দাবিতে জাতীয় সংসদের ৩৫০ জন সদস্যের প্রত্যেকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচীর উদ্বোধনী দিনে সোমবার সকাল ১১টায় ঢাকার রমনায় সংসদ উপনেতার সঙ্গে তাঁর বাসভবনে দেখা করে প্রথম স্মারকলিপি হস্তান্তর করা হয়।

সংস্কার পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. ময়না তালুকদার,সাধারণ সম্পাদক পুলক ঘটক,সহ-সভাপতি সাংবাদিক সুভাষ সাহা,ভানুলাল দাস (পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি) ও গোকুল কৃষ্ণ পোদ্দার (বায়ো কেমিস্ট),সংগঠনের সিনিয়র সদস্য ও মহিলা ঐক্য পরিষদের (বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নারী শাখা) সভাপতি সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য,সংস্কার পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট প্রকাশ রঞ্জন বিশ্বাস,দপ্তর সম্পাদক মুক্তা রাণী শেরপা,কেন্দ্রীয় সদস্য ডা: সুশান্ত বড়ুয়া (পেডিয়াট্রিস্ট),শুভ চন্দ্র দাস (নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক),এডভোকেট দেবাশীষ দেব উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় সংসদে লিঙ্গবৈষম্যহীন উন্নততর হিন্দু আইন পাসের জন্য সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে স্মারকলিপিতে বলা হয়,প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে কোনো ভূমিহীন রাখবেন না ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর এ মহৎ ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য বৈষম্যমূলক হিন্দু আইন সংশোধন করা জরুরি। কারণ বিদ্যমান আইন হিন্দু ও বৌদ্ধ নারীদের সবাইকে ভূমিহীন করেছে।

প্রচলিত আইন সংশোধন করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের সম্পূর্ণ অবসান ঘটানোর দাবি জানিয়ে সংস্কার পরিষদের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “পিতামাতার সম্পত্তিতে সন্তানরা (লিঙ্গপরিচয় নির্বিশেষে) সমান অধিকার পাবেন। একই সাথে স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রী এবং স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামী এক সন্তানের সমপরিমাণ উত্তরাধিকার পাবেন।”

সংখ্যালঘুদের বসতভিটা সংরক্ষণের স্বার্থে শরিকদের অনাপত্তি ছাড়া হিন্দু আইনের আওতাভুক্ত নয় এমন কারও কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বসতভিটা ও বাড়ি বিক্রয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং ক্রেতা হিসেবে নিকটতম শরিকদের অগ্রাধিকার প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ধর্মান্তরিত ব্যক্তির উত্তরাধিকার হরণের প্রস্তাব দিয়ে বলা হয়েছে, “ধর্মান্তরিতরা পূর্বপুরুষের ধর্ম,সংস্কৃতি,জীবনাচরণ ও পরিবার ত্যাগের সঙ্গে পূর্বপুরুষের সম্পত্তিতেও অধিকার ত্যাগ করেছেন বলে গন্য হবেন। দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা,ধর্ম,সংস্কৃতি,পরিবার এবং সম্পত্তি রক্ষার প্রয়োজনে ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিষিদ্ধ করে সংসদে সুস্পষ্ট সংবিধিবদ্ধ আইন পাস করা প্রয়োজন।”

বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনে পুরুষরা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও যতগুলো ইচ্ছা বিয়ে করতে পারেন,যার কোনো আইনগত নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই আদালতের অনুমতি ছাড় একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়।

অসবর্ণ বিবাহ বৈধকরণের দাবি জানিয়ে বলা হয়,ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র ও বিভিন্ন উপবর্ণের নারী-পুরুষেরর মধ্যে অসবর্ণ বিবাহ হরহামেশাই ঘটছে। কিন্তু এসব বিয়ের আইনগত বৈধতা নেই। অবৈধ বিয়ের সন্তানরাও আইনত “অবৈধ” বিবেচিত হয়। অবৈধ সন্তানের পৈত্রিক সম্পত্তিতে অধিকার নড়বড়ে থাকে। এগুলো মানবের প্রতি অবিচারমূলক অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। তাই বৃটিশ আমলে প্রণীতHindu Marriage Disabilities Removal Act 1946সংশোধন করে অসবর্ণ বিবাহের আইনগত বৈধতা প্রদান প্রয়োজন।

হিন্দু আইনে সন্তান দত্তক নেয়া বৈধ হলেও স্বামীর অনুমতি ছাড়া নারী ও লিঙ্গবৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর দত্তক নেওয়ার অধিকার নেই। ছেলে দত্তক নেওয়া যায়,কিন্তু মেয়ে সন্তান দত্তক নেওয়া যায় না। প্রতিবন্ধী শিশুকে এবং ভিন্ন গোত্রের বা ভিন্ন বর্ণের শিশুকে দত্তক নেওয়া যায় না। এরকম নানাবিধ বৈষম্য নিরসন করে আধুনিক,উন্নত ও মানবিক দত্তক আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়।

বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে বিকলাঙ্গ,দৃষ্টি,বাক,শ্রবণ,যৌন ও মানসিক প্রতিবন্ধী এবং যক্ষা ও কুষ্ঠ রোগের মতো তথাকথিত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পত্তির অধিকার পান না। এর নিরসন দাবি করে বলা হয়, “বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সকলের সম্পত্তির সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা,তাদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা বিধান ও অগ্রাধিকার ভিত্তিক সুযোগ প্রদান জরুরি।”

অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে,বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা,শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ আইন প্রণয়ন,সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে পিতা ও মাতার সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং আওয়ামী লীগের বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত অঙ্গীকার অনুযায়ী সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন,জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন,অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ,দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন,পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও পার্বত্য ভূমি কমিশনের যথাযথ বাস্তবায়ন,বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন,সমতলের আদিবাসীদের জন্যে পৃথক ভূমি কমিশন গঠন।

স্মারকলিপিতে বলা হয়,বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে রাষ্ট্র কারও প্রতি বৈষম্য করতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো,বৃটিশ আমলে প্রবর্তিত বিভিন্ন হিন্দু আইনে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা এখনো চালু থাকায় নাগরিকরা রাষ্ট্রের কাছে বৈষম্যই পাচ্ছে। আদালতের কাছে বিচার প্রার্থী হলে হিন্দু নারীরা সম্পত্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন,যা অসাংবিধানিক।