বিতর্কিত নির্বাচনের পর ভেনেজুয়েলায় বিক্ষোভ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক: ভেনেজুয়েলার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিকোলাস মাদুরোকে জয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। এরপরই দেশটিতে ছড়িয়েছে বিক্ষোভ। প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মধ্যেই বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
জবাবে পুলিশও তাদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভেনেজুয়েলায় গত রোববারের বিতর্কিত নির্বাচনী ফলাফলের প্রতিবাদে রাস্তায় নামা বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী।
সোমবার সন্ধ্যায় হাজার হাজার মানুষ মধ্য কারাকাসের রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের কেউ কেউ আবার কয়েক মাইল হেঁটে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের দিকে রওনা হন।
গত রোববারের এই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো জয়ী হয়েছেন বলে দাবি করার পরদিনই ভেনিজুয়েলার রাজধানীতে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিরোধীরা মাদুরোর বিজয়ের দাবিকে জালিয়াতি বলে আখ্যায়িত করেছে। বিরোধীদের দাবি, তাদের প্রার্থী এডমুন্ডো গঞ্জালেজ ৭৩.২ শতাংশ ভোট পেয়ে এই নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্যভাবে জয়ী হয়েছেন।
নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জনমত জরিপও মাদুরোর এই প্রতিদ্বন্দ্বীর স্পষ্ট জয়ের ইঙ্গিত দিয়েছিল।
দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষের মধ্যে গত ১১ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রয়াসে গঞ্জালেজের পেছনে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
এদিকে বেশ কয়েকটি পশ্চিমা এবং লাতিন আমেরিকান দেশের পাশাপাশি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ভেনিজুয়েলা কর্তৃপক্ষকে পৃথক ভোট কেন্দ্র থেকে ভোটদানের রেকর্ড প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছে।
এছাড়া আর্জেন্টিনা প্রেসিডেন্ট মাদুরোর নির্বাচনী বিজয়কে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ভেনেজুয়েলা বুয়েনস আইরেস থেকে কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করেছে। অন্য ছয়টি লাতিন আমেরিকার দেশ - চিলি, কোস্টারিকা, পানামা, পেরু, ডোমিনিকান রিপাবলিক এবং উরুগুয়ে - থেকেও কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করা হয়েছে।
ভেনেজুয়েলার সরকার আগামীকাল বুধবার স্থানীয় সময় রাত ৮টা থেকে পানামা এবং ডোমিনিকান রিপাবলিকের সাথে ভেনেজুয়েলায় যাওয়া-আসার বাণিজ্যিক ফ্লাইট চলাচল সাময়িক স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে নির্বাচনে জালিয়াতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে এবং তাদের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে যেতে বাধা দেওয়ার লক্ষ্যে কারাকাসের রাস্তায় জল কামানসহ ব্যাপক সংখ্যক সামরিক এবং পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিল।
বিক্ষোভের সময় জনতা ‘স্বাধীনতা, স্বাধীনতা!’ স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি সরকারের পতনের আহ্বান জানান।
বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, হাইওয়েতে টায়ার জ্বলছে এবং রাস্তায় বিপুল সংখ্যক মানুষ অবস্থান করছে। আর তাদেরকে লক্ষ্য করে মোটরবাইকে থাকা পুলিশ সদস্যরা টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করছে।
কিছু এলাকায় প্রেসিডেন্ট মাদুরোর পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার পাশাপাশি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং টায়ার, গাড়ি এবং আবর্জনাও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিক্ষোভের এক পর্যায়ে সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল সশস্ত্র পুলিশ, সামরিক এবং বামপন্থি আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং শহরের কেন্দ্রের চারপাশের অনেক রাস্তা বন্ধ করে দেয়।
বিবিসি এমন অনেক লোকের সাথে কথা বলেছে যারা লা লুচা নামে পরিচিত একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল, যার অর্থ ‘লড়াই’।
পাওলা সারজালেজো নামে ৪১ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বলেছেন, সর্বশেষ এই ভোট ছিল ‘ভয়ংকর, জালিয়াতিপূর্ণ। আমরা ৭০ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছি, কিন্তু তারা আবার আমাদের সাথে একই জিনিস করেছে। তারা আবার আমাদের কাছ থেকে নির্বাচন কেড়ে নিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের তরুণদের জন্য, আমাদের দেশের জন্য ভালো ভবিষ্যত চাই।’
তার বাবা ৬৪ বছর বয়সী মিগুয়েল নিজের ছেলের সাথে একমত হয়ে বলেন: ‘তিনি নির্বাচনে হেরেছেন, তার এখন সেখানে থাকার কোনও অধিকার নেই।’
তিনি আরও বলেন: ‘আমরা তরুণদের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যত চাই, কারণ সেটি না হলে তারা দেশ ছেড়ে চলে যাবে। যেখানে তারা ভালো কাজ করতে পারে এবং ভালো উপার্জন করতে পারে সেখানে চলে যাবে। আমাদের সমৃদ্ধ দেশ আছে এবং সে সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। যদি যুবকরা সবাই চলে যায়, তবে ভেনেজুয়েলায় শুধু বয়স্ক মানুষই থাকবে, শুধু প্রবীণ নাগরিকরা।’
ভেনেজুয়েলার পতাকা পরা ক্রিস্টোবাল মার্টিনেজ বলেন, তিনি মনে করেন এই নির্বাচন ছিল একটি ‘প্রতারণা’। তিনি বলেন, লা লুচা এবং আশপাশের এলাকার বেশিরভাগ তরুণরা এমন একটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছে যা তরুণদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ ‘আমাদের মধ্যে অনেকেই বেকার’ এবং ‘অধিকাংশই পড়াশোনা করে না’।
তিনি বলেন, ‘জীবনে এই প্রথম ভোট দিলাম। আমি সেখানে সকাল ছয়টা থেকে আনুমানিক সকাল নয়টা পর্যন্ত ছিলাম এবং দেখলাম রাস্তায় অনেক লোক জড়ো হচ্ছে। সরকারের প্রতি অনেক অসন্তোষ ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পরিবর্তনের জন্য অংশ নিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, প্রেসিডেন্ট মাদুরো দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার সময় দেশের ‘কোনও পরিবর্তন’ হয়নি এবং ‘প্রেসিডেন্ট শ্যাভেজ মারা যাওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ’ হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ১১ বছর ক্ষমতায় থাকার পর প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে গঞ্জালেজের পেছনে বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। নির্বাচনের আগে পরিচালিত জনমত জরিপেও দেখা গেছে, এডমুন্ডো গঞ্জালেজ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে পরাজিত করবেন।
গত ২৫ বছর ধরে ভেনেজুয়েলায় ক্ষমতায় রয়েছে সমাজতান্ত্রিক পিএসইউভি পার্টি। প্রথমে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের নেতৃত্বে এবং ২০১৩ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শ্যাভেজের মৃত্যুর পর নিকোলাস মাদুরোর শাসনাধীনে রয়েছে দেশটি। দেশটির অনেক ভোটার বলছেন, তারা পরিবর্তন চান।