দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: দেশে সরকার পতনের প্রভাব পড়েছে চারদিকে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ঘটে এক কলঙ্কিত ঘটনা।

 

 

একদলদুষ্কৃতিকারী ধানমন্ডিস্থ ঐতিহ্যবাহী ক্লাব আবাহনী লিমিটেডে প্রবেশ করে ব্যাপক লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটায়। ক্লাবের অস্থায়ী ভবনের ৮টি কক্ষের প্রতিটিতে ভাঙচুর চালানো হয়। নগদ অর্থের পাশাপাশি লুট করা হয় ক্লাবের ৫২ বছরের অর্জনের সব স্মারক ট্রফি।

ক্ষয়ক্ষতি দেখতে আজ বিকেলে বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের আবাহনীর সাবেক খেলোয়াড় ও কয়েকজন সাবেক-বর্তমান পরিচালক এসেছিলেন ক্লাব প্রাঙ্গণে। তারা আকুতি জানালেন দেশের অন্যতম সেরা এই ক্লাবটির ট্রফি ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ফেরত দেওয়ার। সাবেক তারকা ও কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজনের বক্তব্য তুলে ধরা হলো-

আব্দুস সাদেক, আবাহনীর ফুটবল ও হকি দলের প্রথম অধিনায়ক ও সাবেক হকি তারকা

৫২ বছর আগে ১৯৭২ সালে আমি প্রথম খেলি ফুটবল ও হকি। দু'টি দলেরই প্রথম বছরের অধিনায়ক ছিলাম আমি। ৫২ বছর হয়ে গেলো এই ক্লাবে এসেছি। সামনে আমার কিছু ট্রফি দেখছি। ১৯৫২ সালের নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আবাহনী ক্লাব হলো শ্রেষ্ঠ ক্লাব। কেবল ফুটবল, হকি নয়, ক্রিকেট, টেবিল টেনিস- এই চারটা খেলায় আমার মনে হয় না আর কেউ এতটা সম্মান অর্জন করতে পেরেছে। আগে মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স ছিল। তবে ৫০ বছরে এত এত ট্রফি আমরা অর্জন করেছি। এই ট্রফির সংখ্যা কত আমি ঠিক জানি না। ১৯৭৪ সালে আমরা তিনটি খেলাতেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এরপর তো শত শত ট্রফি ক্লাবটি জিতেছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ক'দিন আগে একটি অপ্রীতিকর ঘটনায় ক্লাব থেকে শতশত ট্রফি কে বা কারা নিয়ে গেছে। আমি আপনাদের মাধ্যমে অনুরোধ করবো, এই ট্রফিগুলো যাতে ক্লাবকে ফেরত দেওয়া হয়। এর বেশি কিছু চাচ্ছি না।

একটি ঘটনায় আমাদের ৫২ বছরের অর্জন নিয়ে গেছে। যারা নিয়ে গেছেন, তাদের কাছে অনুরোধ, এই অর্জনগুলো যাতে পরবর্তী প্রজন্মকে দেখাতে পারি, সেজন্য ফিরিয়ে দিন। সেটা যদি দেখাতে না পারি আপনারাই কষ্ট পাবেন। আপনারা ফিরিয়ে দিন। আশ্বস্থ করছি এখানে কোনো খারাপ কিছু হবে না। ক্রীড়া উপদেষ্টার কাছে অনুরোধ আপনি ক্লাবগুলোকে সহায়তা করুন। নিরাপত্তা দিন।

খালেদ মাহমুদ সুজন, জাতীয় দল ও আবাহনীর সাবেক ক্রিকেটার ও অধিনায়ক, পরিচালক, বিসিবি

আমি এখানে মাত্র তিন মৌসুম খেলেছি। তবে কোচ হিসেবে এই ক্লাবের সঙ্গে আমার অনেক দিনের সম্পর্ক। আমরা এখানে যারা এসেছি, সবাই আমরা খেলোয়াড়। এই ট্রফিগুলো খেলোয়াড়দের অনেক কষ্টের ফসল। অনেক ঘাম ঝরিয়ে এই ট্রফিগুলো আমরা সবাই মিলে অর্জন করেছি। এই ট্রফিগুলো যখন চলে গেছে, সেটা আমাদের জন্য অনেক কষ্টের। এই ট্রফিগুলো তো কোনো দোষ করেনি। আমরা যারা খেলেছি, ক্রিকেট, ফুটবল, হকি দলের হয়ে, আমরা তো দোষ করিনি। আবাহনীর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্মৃতি ছিল অনেক। ট্রফি কক্ষে যখন যেতাম, সেগুলো দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তাম। ট্রফির সামনে দাঁড়িয়ে বলতাম, এই বছর আমরা এই ট্রফি জিতেছি। ক্লাবে ভাঙচুর করেছে, কিন্তু ট্রফিগুলো কেন নিয়ে গেল সেটা আমাদের কারওই বোধগম্য নয়। এজন্য খারাপ লাগছে। অনুরোধ করি, ট্রফিগুলো রেখে কোনো লাভ হবে না। এটা স্বর্ণের বা হীরার কোনো ট্রফি নয়। তবে আমাদের কাছে এসব ট্রফি অনেক অমূল্য। অনেকে আবাহনী বলতে আওয়ামী লীগ বোঝায়, মোহামেডান বলতে বিএনপি বোঝায়। এটা ঠিক না। আমরা তো ঘুরে ঘুরে দুই ক্লাবেই খেলেছি। আমি মনে করি খেলার সঙ্গে রাজনীতিকে জড়ানো ঠিক নয়। যাদের জন্য এই ক্লাব ছিল রুটি রুজির স্থান- তাদের কী হবে? তার পরিবারটা কীভাবে চলবে, তার সন্তান কী করে স্কুলে যাবে। এটা অনেক কঠিন সময়। আমরা দেশটাকে আগে গড়ার চিন্তা করি। সবাই সবার থেকে চেষ্টা করি। দেশের খেলাকে এগিয়ে যেতে হবে।

কাজী এনাম আহমেদ, পরিচালক, আবাহনী লিমিটেড

আবাহনী অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। অনেক খেলোয়াড়, কর্মকর্তা এখানে ছুটে এসেছেন। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমাদের ক্লাবে যে আক্রমণটা হয়েছে মনে অনেক ব্যথা পেয়েছি। আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের যে অর্জন, এতগুলো ট্রফি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই ক্লাবটি বাংলাদেশের ক্লাব। সমর্থকদের ক্লাব। খেলোয়াড়দের ক্লাব, ধানমন্ডির ক্লাব। আমি সরকার ও প্রশাসনকে অনুরোধ করবো আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখেন। গত কয়েকদিন দেখেছি, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কেবল আবাহনী নয়, আরও কয়েকটি ক্লাবে এরকম হামলা হয়েছে। আপনারা দয়া করে ক্লাবগুলো, তাদের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখেন। এই যুব সমাজ, ছাত্ররা কিন্তু খেলা পছন্দ করে। আমাদের আবাহনী ক্লাবের সমর্থকগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ ছাত্র ও তরুণ। আমার মনে হয় কিছু দুর্বৃত্ত এসব করেছে, ট্রফিগুলো যাদের কাছে আছে অনুরোধ করবো, এখানে যারা সাবেক খেলোয়াড় আছেন, তাদের জন্য, আমাদের সমর্থকদের জন্য ট্রফিগুলো ফেরত দিন। অবশ্যই আমরা সরকারের কাছে, ক্রীড়া উপদেষ্টা যিনি আছেন, তাদের কাছে যেতে পারি, সব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি। দেখেন, আবাহনী একটি ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। ৫২ বছর ধরে আবাহনী খেলে যাচ্ছে। আবাহনী এবারও সব খেলায় দল গড়বে। আগামী ৫২ বছরেও খেলবে।

গাজী আশরাফ লিপু, আবাহনীর সাবেক অধিনায়ক ও প্রধান নির্বাচক, বিসিবি

এখানে অনেক খেলোয়াড় আছেন, অনেক সংগঠক আছেন। যাদের সঙ্গে আমরা খেলেছি। আমাদের ক্লাবটি ভাঙচুর হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হলো যে ট্রফিগুলো, আমাদের পারফরম্যান্সের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছিলাম, সেগুলো সব লুট হয়ে গেছে। আমার বয়স যখন ২০ বছর ১৯৮০ সালে এখানে খেলতে আসি। বহু বছর খেলোয়াড় হিসেবে ছিলাম, কোচ-কর্মকর্তা হিসেবে ছিলাম। এই ট্রফিগুলো নিয়ে আমাদের অনেক স্মৃতি জড়িত। এখানে ক্রিকেটার ছাড়াও ফুটবলার, হকি খেলোয়াড়, টেবিল টেনিস খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা আছেন। এই ট্রফিগুলো ঘিরে আমরা অনেক আনন্দ-উচ্ছ্বাস করেছি। আমি মর্মাহত। নিশ্চয়ই দুর্বৃত্ত ছাড়া এরকম কাজ করতে পারে না। যে কোনো মাধ্যমে হোক ট্রফিগুলো ফেরত চাই। আমাদের অনেকেই এখানে ষাটোর্ধ্ব বয়স। জানি না কতদিন বাঁচবো। জীবন থাকতে এই ট্রফিগুলো আবার দেখে যেতে চাই। সেটাই হবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। যারা জড়িত ছিলেন, আপনাদের ওপর আমাদের কোনো ক্ষোভ নেই। আপনারা ট্রফিগুলো ফেরত দেন। এছাড়া সামনে ক্রিকেট-ফুটবল মৌসুম আসছে। আবাহনী যাতে বরাবরের মতোই ভালো দল গড়তে পারে, কর্মকর্তাদের যেন সেই সুযোগ দেওয়া হয়।

দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, জাতীয় দল ও আবাহনীর সাবেক ফুটবলার ও অধিনায়ক

এই ট্রফিগুলো বিক্রি করে কিন্তু খুব বেশি টাকা পাওয়া যাবে না। তবে আমরা এখানে যারা আছি, তাদের ৫২ বছরের প্রাপ্তি কিন্তু শেষ হয়ে যাবে। এখানে অনেকেই কিন্তু ক্লাব প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত নই। আমাদের এখানে আসার কারণটা একটাই আমরা বিভিন্ন সময় এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের অর্জনগুলো আমাদের ফিরিয়ে দিন। আপনারা এই ট্রফিগুলো ঘরেও রাখতে পারবেন না। ঘরে রাখলে কেউ এসে প্রশ্ন করলে কোনো সদুত্তরও দিতে পারবেন না। তাই আপনারা যদি এই ট্রফিগুলো ফিরিয়ে দিয়ে যান আমরা অত্যন্ত খুশি হবো। সেই সঙ্গে প্রশাসনে যারা আছেন, সরকারে আছেন, উপদেষ্টা আছেন, দয়া করে আবাহনীর মতো ক্লাবগুলোর একটু নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। আবাহনী-মোহামেডান কোনো পাড়ার দল না। এটা জাতীয় দল। আপনারা জানেন এই দুই ক্লাবে সারা দেশ বিভক্ত হয়ে যায়। এই ক্লাবগুলোর সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগসূত্র নেই। বিশ্বকাপের সময় যখন দেশটা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলে দু'ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তখন কিন্তু ঘরে ঘরে হামলা হয় না। এই ট্রফিগুলো ফিরিয়ে আনতে যদি কাউকে অর্থও দিতে হয়, সেটা দিতে আমরা রাজি আছি।

আবদুল গাফফার, জাতীয় দল ও আবাহনীর সাবেক ফুটবলার

একটি ঘটনায় আমাদের ৫২ বছরের অর্জন নিয়ে গেছে। যারা নিয়ে গেছেন, তাদের কাছে অনুরোধ, এই অর্জনগুলো যাতে পরবর্তী প্রজন্মকে দেখাতে পারি, সেজন্য ফিরিয়ে দিন। সেটা যদি দেখাতে না পারি আপনারাই কষ্ট পাবেন। আপনারা ফিরিয়ে দিন। আশ্বস্ত করছি এখানে কোনো খারাপ কিছু হবে না। ক্রীড়া উপদেষ্টার কাছে অনুরোধ আপনি ক্লাবগুলোকে সহায়তা করুন। নিরাপত্তা দিন।