এক মাসে ৯০৭ পুলিশ সদস্যের পদোন্নতি
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই শুরু হয়েছে পুলিশকে ঢেলে সাজানোর কার্যক্রম। রদবদল, পদোন্নতি এবং পদায়নের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেওয়ার পর এ প্রক্রিয়ায় অধিকতর গতি আসে। ইতোমধ্যেই পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসাবে সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব সরফরাজ হোসেনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
আগামী ১ অক্টোবর থেকে এই কমিশনের কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে যুগান্তরকে জানিয়েছেন সরফরাজ হোসেন। পুলিশ সদর দপ্তর এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ভাষ্য-‘পুলিশ প্রশাসনকে আওয়ামী দোসরমুক্ত করে বৈষম্যমুক্ত একটি যুগোপযোগী আধুনিক বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলা হবে। সে লক্ষ্যেই কার্যক্রম চলমান।’ কিন্তু একটি চক্র কৌশলে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এ প্রক্রিয়ায়। তারা জড়িয়ে পড়ছে বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি বাণিজ্যে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সফলও হচ্ছে। এ কারণে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাপ্রাপ্ত কিছু পুলিশ কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এ পর্যন্ত ৯০৭ জন পুলিশ সদস্যের পদোন্নতি হয়েছে। ইতোমধ্যেই তাদের পদোন্নতিজনিত পদে পদায়নও করা হয়েছে। এদের মধ্যে পুলিশ সুপার (এসপি) থেকে অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা ১১১ জন। আছেন অতিরিক্ত আইজি (গ্রেড-১) একজন, ডিআইজি ৮০ এবং এসপি ৩০ জন। ৬৪ জেলার মধ্যে ইতোমধ্যেই ৫০টি জেলায় নতুন এসপির পদায়ন করা হয়েছে। সব মেট্রোপলিটন পুলিশে দেওয়া হয়েছে নতুন কমিশনার। একইভাবে সব রেঞ্জ অফিসে পদায়ন করা হয়েছে নতুন ডিআইজি। শুধু তাই নয়, কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার ৭৫৩ জন পুলিশ সদস্যকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে গত এক মাসে। এদের মধ্যে কনস্টেবল থেকে নায়েক হয়েছেন ৬৭৭ জন। এছাড়া কনস্টেবল থেকে এটিএসআই পদে ১২ জন, কনস্টেবল/নায়েক থেকে এএসআই ৩১ জন, এএসআই থেকে এসআই ১৮ জন নায়েক থেকে এএসআই (সশস্ত্র) ও এএসআই (সশস্ত্র থেকে এসআই (সশস্ত্র) পদে ১৫ জন এবং এটিএসআই থেকে টিএসআই পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ছয় জন।
এদিকে গত এক মাসে পুলিশ পরিদর্শক হিসাবে ৪৩ জন কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে।
এদের মধ্যে এসআই (নিরস্ত্র) থেকে পরিদর্শক (নিরস্ত্র) পদে ১৬ জন, এসআই (সশস্ত্র) থেকে পরিদর্শক (সশস্ত্র) পদে ২৬ জন এবং সার্জেন্ট থেকে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন একজন। এছাড়া সারা দেশে পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার ৮৩২ জন কর্মকর্তার পদায়ন হয়েছে। এদের মধ্য থেকেই দেশের বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে থানার সংখ্যা ৬৬৪। এর মধ্যে বিভিন্ন রেঞ্জের অধীন ২২৯টি এবং মেট্রোপলিটনের অধীনে রয়েছে ১১০টি থানা। বাকি থানাগুলো হলো হাইওয়ে ও নৌ পুলিশের। সব মিলিয়ে পুলিশের অপারেশনাল থানা হলো ৬৩৯টি।
পুলিশের একজন ডিআইজি যুগান্তরকে জানান, ডিআইজি রেজাউল হক ছাত্রজীবনে ছিলেন জাসদ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার সভাপতি। ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএসে সহকারী পুলিশ সুপার হিসাবে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। ২০০৭ সালে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন লাইবেরিয়া এবং ২০১০-১১ সালে কঙ্গো মিশনে যান। ফিরে এসে রাজবাড়ী জেলায় পুলিশ সুপার পদে যোগদান করেন। ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট পর্যন্ত তিনি রাজবাড়ীতে কর্মরত ছিলেন। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর তিনি ফেনী জেলার পুলিশ সুপার পদে যোগদান করেন। তিনি আড়াই বছর ফেনীতে দায়িত্ব পালন করেন। ফেনী থেকে ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি হিসাবে বদলি করা হয়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান। ২০২২ সালের ১১ মে পদোন্নতি পেয়ে ডিআইজি হন। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের অস্থাভাজন এই কর্মকর্তা পুলিশ সদর দপ্তরে ডিসিপ্লিন শাখায় কর্মরত থাকার সময় অনেকের চাকরি গেছে তার হাত দিয়ে। তিনি ছিলেন আওয়ামী সরকারের একজন সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও পেলেন ‘প্রাইজ পোস্টিং’। সম্প্রতি তিনি যোগ দিয়েছেন খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি হিসাবে। এতে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। বিষয়টি বর্তমান সরকারের চেতনার পরিপন্থি বলেও মন্তব্য করেন বিসিএস ১৫তম ব্যাচের ওই ডিআইজি।
জানতে চাইলে ডিআইজি রেজাউল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি একজন পেশাদার পুলিশ কর্মকর্তা। ডিসিপ্লিন শাখায় কর্মরত থাকার সময় দায়িত্বের অংশ হিসাবেই অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। এ কারণে বিশেষ মহল আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিষয়টি খেয়াল রাইখেন।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০১ সালে কনস্টেবল হিসাবে পুলিশে যোগদান করেছিলেন অলিউল্লাহ। তিনি এখন শতকোটি টাকার মালিক। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুদফায় পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন এসআই। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক দুই প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া এবং ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমানের ক্যাশিয়ার হিসাবে তার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। অলিউল্লাহর অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৫ সালে এএসআই এবং ২০১৮ সালে এসআই পদে পদোন্নতি পান তিনি। দৈনিক যুগান্তরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক প্রতিবেদন। অনিয়মের অভিযোগে কিছুদিন আগে তাকে সিআইডি থেকে এপিবিএন পার্বত্য এলাকায় বদলি করা হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ৮ আগস্ট তাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সেন্ট্রাল রিজার্ভ অফিসার-১ (আর ও-১) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। লোভনীয় এই পদে যোগ দিতে অলিউল্লাহকে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় এসআই অলিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমাকে ডিএমপিতে পদায়নের ক্ষেত্রে কোনো আর্থিক লেনদেন হয়নি। আপনি সরাসরি দেখা কইরেন। বিস্তারিত কথা বলব।
সূত্র জানায়, পদায়ন বাণিজ্য সিন্ডিকেটের নেপথ্যে রয়েছেন একজন ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তার এখতিয়ার ডিএমপির মধ্যে হলেও সারা দেশে কার পদায়ন কোথায় হবে, কাকে কাকে পদোন্নতি দিতে হবে-এসবের তালিকা তিনি তৈরি করেন। এছাড়া পুলিশ সদর দপ্তর এবং এসবিসহ পুলিশের অন্যান্য ইউনিটের কোনো কোনো কর্মকর্তাও এই সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে। বিষয়টি অবগত হয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরও। এদিকে গত ৩১ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ‘একটি চক্র পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন ইউনিটে পোস্টিংয়ের ভয় দেখিয়ে অর্থ দাবি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ধরনের প্রতারক চক্র থেকে সতর্ক থাকার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে।’ এর পরও থেমে নেই চক্রের তৎপরতা।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এরই অংশ হিসাবে পুলিশ সংস্কার কমিশন প্রধানের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশে যেসব পদোন্নতি ও পদায়নের আদেশ দেওয়া হয়েছে সেগুলো অপরিহার্য ছিল। পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে সততা, দক্ষতা, পেশাদারিত্ব, নেতৃত্ব প্রদানের সক্ষমতা, সার্ভিস রেকর্ড ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পদোন্নতি-পদায়নের ক্ষেত্রে যদি দুই-একটি জায়গায় কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকে সেগুলো অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষ সংশোধান করবে। কারও বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্তসাপেক্ষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
(সোর্স: যুগান্তর)