মাহি হাসান, দ্য রিপোর্ট : গত ৫ই আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালানোর পর সংস্কারের হাওয়া লেগেছে দেশের প্রতিটি সেক্টরে। পরিবর্তন আসছে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনে। বের হয়ে আসছে হাসিনা যুগের দুর্নীতির কালো অধ্যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি হয়নি এমন সেক্টর নেই। হাসিনার সুবিধাভোগীদের কালো ছায়া থেকে বাদ যায়নি দেশের পুঁজিবাজার।

শেখ হাসিনার নিজের লোক হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজন্যাস ফ্যাকাল্টির সাবেক ডীন অধ্যাপক শিবলী রুবায়াত উল ইসলাম ছিলেন হাসিনার শাসনামলের শেষ কয়েক বছর। এই সময় পুঁজিবাজারের নেমে আসে করুণ দশা। সাবেক বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবায়াত উল ইসলাম বার বার আশ্বাস দিয়ে গেছেন পুঁজিবাজার ভালো হবে। কিন্তু ভালো আর হয়নি। ১০ আগস্ট বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম পদত্যাগ করেন। শুধু শিবলী রুবায়াতই নয়। শিবলী রুবায়াত কমিশনের চার কমিশনার পদত্যাগ করেছে যারা সবাই হাসিনা সরকারের লোক হিসেবে পরিচিত।

চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দুইদিন পরে ১২ আগস্ট পদত্যাগ করেন কমিশনার অধ্যাপক ড. শামসুদ্দিনআহমেদ ও ড. রুমানা ইসলাম। আর সর্বশেষ ১৭ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করলেন কমিশনার ড. এটিএম তারিকুজ্জামান। তবে পদত্যাগ না করে এখনো নিজ দায়িত্বে রয়েছেন কমিশনার মোহাম্মদ মহসিন চৌধুরী। যিনি আগে ছিলেন কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক। গত ৮ মে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম তারিকুজ্জামান ও কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ মহসিন চৌধুরীকে নিয়োগ দেয় শেখ হাসিনা সরকার।

অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ১৮ আগস্ট খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে বিএসইসি'র চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। ২৮ আগস্ট সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. আলী আকবরকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। পরে ৩ সেপ্টেম্বর ফারজানা লালারুখকে বিএসইসির কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তবে সবকিছু ঢেলে সাজানো হলেও এখনও স্বপদে রয়ে গেছেন মোহাম্মদ মহসিন চৌধুরী। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন দেশ পুর্নগঠনের অংশ হিসেবে এখন পরিবর্তন দরকার সব জায়গায়। দুর্নীতিতে জঞ্জালে ভরপুর ছিল হাসিনার আমলের পুঁজিবাজার। যার দায় এড়াতে পারেন না তৎকালীন কর্মকর্তারা। ফলে সে সময়ের দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা এখন দায়িত্বে থাকতে পারেন না।

পুঁজিবাজার সংস্কারের অংশ হিসেবে গত ২ সেপ্টেম্বর ডিএসইতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়।
নিয়োগ পাওয়া পরিচালকেরা হলেন ডিএসইর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও মালদ্বীপ ইসলামি ব্যাংকের চেয়ারম্যান কে এ এম মাজেদুর রহমান, আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাহিদ হোসেন, সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মফিজুল ইসলাম রাশেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির বিভাগের অধ্যাপক ও সিরডাপের গবেষণা পরিচালক মো. হেলালউদ্দিন, মেটলাইফ বাংলাদেশের সাবেক মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ হাম্মাদুল করীম এবং বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার ও ডিজাস্টার রিকভারি সাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইসহাক মিয়া। এই নিয়োগ জন্ম দেয় আরো বিতর্কের। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন থেকে দাবি করা হয়।

এঁদের মধ্যে কে এ এম মাজেদুর রহমান, মো. হেলালউদ্দিন ও ড. নাহিদ হোসেনকে নিয়ে আইনি আপত্তি উঠে।

ডিএসই রেগুলেশনস ও ডিমিউচুয়ালাইজেশন স্কিম অনুযায়ী তিন বছরের মধ্যে ব্রোকারেজ হাউসের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ স্বতন্ত্র পরিচালক হতে পারবেন না। কোনো নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কর্মীও ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক হতে পারবেন না। অথচ মাজেদুর রহমান ও হেলালউদ্দিন গত তিন বছরের মধ্যে ডিএসইর ট্রেকহোল্ডার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিএসইসি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হলেও তা এফআইডির অধীনে পরিচালিত হয়। অতীতেও বিএসইসির বিভিন্ন বিষয়ে এফআইডির হস্তক্ষেপ করার নজির রয়েছে। আর সেই এফআইডির অতিরিক্ত সচিব ড. নাহিদ হোসেন। এসব কারণে তাঁদের ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়ায় বিতর্ক উঠে। এসব কারণে কেএএম মাজেদুর রহমানের পরে ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন সরে দাঁড়িয়েছেন। তারা ২জন পর্ষদে যোগ দেবেন না। কিন্তু ড. নাহিদ হোসেন এখনও সরে দাঁড়ান নি।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বৈরশাসক আওয়ামীলীগের অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগী নাহিদ। তারপরেও এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন এই অতিরিক্ত সচিব ড. নাহিদ হোসেন। এমন ব্যাক্তিকে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

ড. নাহিদের বিষয়ে সমালোচনা রয়েছে যে তিনি বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সরাসরি ছাত্র এবং তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সহযোগী ছিলেন।

এছাড়া দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (সিআরও)। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী লোকদের ব্যবহার করে ওই পদে চাকরী বাগিয়ে নেন অযোগ্য ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ। যিনি ডিএসইতে যোগদানের আগে মার্চেন্ট ব্যাংকে চাকরী করাকালীন সবচেয়ে বাজে কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে এনেছেন। খায়রুল বাশারের আইপিওতে আনা ৩টি কোম্পানির মধ্যে জাহিন স্পিনিং ও ওয়াইম্যাক্স ইলেকট্রোডস অস্বিত্ব সংকটে। কোম্পানি দুটির যাচ্ছে-তাই অ্যাকাউন্টস বানিয়ে শেয়ারবাজারে আনা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, খায়রুল বাশার বিএসইসির সাবেক কমিশনার ও তার বন্ধু শেখ সামসুদ্দিন এবং আর্থিক খাতে আলোচিত নাম চৌধুরীনাফিজ সরাফাতের প্রভাব খাটিয়ে ডিএসইর সিআরও পদ বাগিয়ে নেন। তিনি নিজের যোগ্যতায় সিআরও হননি।
এছাড়া পুজিবাজার সংশ্লিষ্ট আরেক প্রতিষ্ঠান শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিশিষ্ট শিল্পপতি এবং স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী।

এদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটের (বিআইসিএম) নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ তারেক পদত্যাগ করেছেন। এখনো নিয়োগ হয়নি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটিতে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট আরেক প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশের যে টাকা বিতরণ করেনি তা দেখভাল করতে ২০২১সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসএফ)। এ কাজের জন্য ১১ সদস্যের বোর্ড অব গভর্নরের পাশাপাশি, প্রায় অর্ধডজন কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটির অন্তত ৫৪টি সভা করা হয় মাত্র এক বছরে। এসব সভায় কমিটির সদস্যদের সম্মানী ও বিভিন্ন সভা আয়োজন করে মোট পরিচালন খরচের এক-তৃতীয়াংশ খরচ করেছে। টাকার অংকে যা মোট ২ কোটি ১২ লাখ টাকা। নজিবুর রহমান সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর এই টাকা ব্যবস্থাপনার জন্য সিএমএসএফ'র পর্ষদের দায়িত্ব পান। নজিবুর রহমান তহবিলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১১ সদস্যের বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। গত মাসে তার তিন বছরের মেয়াদ শেষ হয়। পুজিবাজার সংশ্লিষ্ট এই প্রতিষ্ঠানে এখনো নিয়োগ দেয়া হয়নি।

এছাড়া, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন অধ্যাপক আবু আহমেদ। আগামী তিন বছরের জন্য তাকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

এদিকে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সাধারণ বীমা করপোরেশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন সরকারের সাবেক সচিব ও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী। সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ আদেশ জারি করেছে।

এছাড়া বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম‌্যানহিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক সিনিয়র সচিব ড. এম আসলাম আলম। তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও বীমার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে। মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য অবশ্যই সম্মিলিত প্রচেষ্টা লাগবে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার বিকল্প নেই।

তবে সরকার পতনের পর ঢেলে সাজানোর ঘোষণা দেওয়া হয় পুঁজিবাজারে। ইতোমধ্যে শেয়ারবাজারের ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে ৫ সদস্যের বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের এক সভায় এই তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

তদন্ত কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে কমিশনে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

সম্প্রতি বিএসইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, বিএসইসিতে কমিশনারদের মতো অনেক অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। এই কমিশনে কমিশনারদের মতো কর্মকর্তা- কর্মচারীদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এজন‍্য পুরো কমিশন পূণঃগঠন করতে হবে।

এছাড়া পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ১২ দফা দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। গত শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বিজয়নগরে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরামের (সিএমজেএফ) অডিটরিয়ামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান বাংলাদেশ পুজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত পরিষদের সভাপতি আতাউল্লাহ নাঈম।

এদিকে, পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক দর পতনের প্রতিবাদে বুধবার (২ অক্টোবর) মানববন্ধন করেছেন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের বিনিয়োগকারীরা। এ সময় তারা বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগ দাবি করেন এবং ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ গঠন করার দাবি জানান।

আতাউল্লাহ নাঈম ১২ দফা দাবি তুলে ধরেন। তিনি পুঁজিবাজারে আ্ওয়ামী শাসন আমলের সকল দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তার অপসারণ দাবি করেন।

সার্বিক বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পরিচালক ও মুখপাত্র ফারহানা ফারুকী বলেন, আমরা ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছি। দ্রুত এর সুফল দেখা যাবে।

(মাহা/টিআইএম/এসএম/০১/১০২৪)