তৃণমূলে আস্থাহীনতা ও হতাশা
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে খুঁজছে বিএনপির নেতাকর্মীরা
তারেক সালমান ও মাহমুদুল হাসান, দিরিপোর্ট : সরকার বিরোধী আন্দোলনের চরম মুহূর্তে ‘আত্মগোপনে’ থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে খুঁজে ফিরছে বিএনপির তৃণমূল কর্মীরা। তাদের অভিযোগ এই সময় মাঠে থেকে সাহস ও ভরসা দেওয়ার বদলে তিনি আত্মগোপন করেছেন। তার সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ন্যূনতম যোগাযোগও করতে পারছে না।
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের সঙ্গে সঙ্গে অন্য সিনিয়র নেতারাও আত্মগোপনে থাকায় তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আস্থাহীনতা ও হতাশা।
সরকার পতন ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে টানা ৮৪ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আত্মগোপনে রয়েছেন। মঙ্গলবার বিকেলে টেলিফোনে মন্ত্রিসভা রূপান্তর নয়, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগে সমাধানের পথ উন্মুক্ত হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ সময়ও তার অবস্থান সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারেনি।
ফখরুল বলেন, মন্ত্রিসভা রূপান্তরে মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র জমা নেওয়ার ঘটনা সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে আমরা মনে করি। এরকম কার্যক্রম সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। তিনি বলেন, আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, মন্ত্রিসভা রূপান্তরে সংকটের সমাধান আসবে না। সমাধান চাইলে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। এতে সংলাপের বন্ধ পথ উন্মুক্ত হবে বলে আমরা মনে করি।
এর আগে সর্বশেষ গত শুক্রবার বিকেলে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ১৮ দলীয় জোটের মহাসচিবদের সঙ্গে বৈঠকের পর থেকে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
সিনিয়র কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তারের পরিপ্রেক্ষিতে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিরাপদ স্থানে থেকে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন।
এদিকে বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরা অভিযোগ করছেন, ইতোপূর্বে কয়েকবার সরকার পতনের আল্টিমেটাম দিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব তাতে সফল হতে পারেননি। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী গুমের পর এই আন্দোলন প্রায় সফলতার প্রান্তে চলে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষ ইলিয়াস আলী ইস্যুতে বিএনপির আন্দোলনে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়েছিল। তখন সরকার ভয় পেয়ে দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ও আটক অভিযানে নামে। সে সময় দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হঠাৎ করেই ‘ফাইট’ না দিয়ে আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। আন্দোলনের তুমুল মুহূর্তে দলের দ্বিতীয় সাংগঠনিক নেতার (মির্জা ফখরুল) এভাবে মাঠ ছেড়ে পলায়ন দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীর মন ভেঙে দেয়। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের ওই সময়ের আত্মগোপন দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার বন্যা বয়ে যায়। সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারাও এ নিয়ে চরম রসালো আলোচনা করেন। এক পর্যায়ে মির্জা ফখরুল গোপনে আদালতে জামিনের জন্য যান। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। তাকে জেলে যেতেই হয়। কিন্তু ওভাবে পলায়ন না করে নেতাকর্মীদের সামনে থেকে তিনি গ্রেফতার হলে ওই আন্দোলন থেমে যেত না। বরং নেতাকর্মীরা আরও চাঙা হয়ে উঠতো।
তৃণমূল কর্মীরা জানান, দেখতে দেখতে সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে ও দলকে সু-সংগঠিত করতে না পারায় এখনও আন্দোলনে সফলতার মুখ দেখছে না। প্রায় দু‘সপ্তাহ আগে সরকারের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর মন্ত্রিপরিষদ থেকে মন্ত্রীরা পদত্যাগ করলেও এখনও পূর্ণ শক্তি নিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে সরকার। এটা শুধু বিএনপির সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণেই সম্ভব হচ্ছে।
সাধারণ কর্মীদের অভিযোগ, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও বিএনপি এখনও নিজের বিশাল কর্মী বাহিনীকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। এ কারণেই দেশের সাধারণ মানুষের মাঝেও বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে আস্থা তৈরি হয়নি। বরং সৃষ্টি হয়েছে অবিশ্বাস, ক্ষোভ ও হতাশা। এ অবস্থাতেও দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে দলের সিনিয়র নেতারা কখনও আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নেননি। যার দায়ভার এখন দলকেই বহন করতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, দলীয় ফোরাম, জাতীয় প্রেস ক্লাব ভিত্তিক আলোচনা, ১৮ দলীয় জোট শরিকদের সঙ্গে বৈঠক, সংবাদ সম্মেলনে পারদর্শীতার পরিচয় দিলেও আন্দোলন-সংগ্রামে এখনও নিজের দক্ষতা দেখাতে পারেননি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পারেননি দেশের লাখ লাখ সাধারণ নেতাকর্মীকে সংগঠিত করার মতো উদ্যোগ নিতে। সৃষ্টি করতে পারেননি সামনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার নজির। এসব কারণেই নেতাকর্মীদের আস্থা ও ভরসার জায়গায় দুর্বল হয়ে পড়ছেন তিনি। তার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না স্থায়ী কমিটির অনেক নেতা।
দলীয় সূত্র আরও জানায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের পলায়ন মানসিকতার প্রভাব শুধু তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে নয়, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দলের সিনিয়রসহ সর্বস্তরের নেতাদের ওপর। আন্দোলনের শেষ ও চূড়ান্ত সময়েও আগের মতোই কেন্দ্রীয় নেতারা কর্মসূচি সফলে মাঠে নামছেন না। এতে বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ হচ্ছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
এছাড়া মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে তার দায়িত্বকালীন সময়ে জেলা পর্যায়ের কমিটি গঠন নিয়েও নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বেশিরভাগ জেলাতেই কমিটি করা হয়েছে গোজামিলের। নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও কোন্দল দানা বেধেছে। উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোও গঠন করা হয়নি। আর এসব সমস্যা নিরসনে চোখে পড়ার মতো সঠিক কোন উদ্যোগও গ্রহণ করেননি তিনি। একমাত্র নিজের জেলা ঠাকুরগাঁও ছাড়া তিনি তেমন কোনো জেলা ও সাংগঠনিক জেলা সফর করেননি। উল্লেখ্য, মির্জা ফখরুল নিজ জেলা ঠাকুরগাঁও বিএনপির সভাপতি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তৃণমূলের এক নেতা বলেন, হরতাল ডেকেই চুপ শীর্ষ নেতারা। চলে যাচ্ছেন আত্মগোপনে। যোগাযোগের মাধ্যম মোবাইল ফোনও প্রায় নেতা রাখছেন বন্ধ। দু‘একজন খোলা রাখলেও তা রিসিভ করেন না। তাদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীরা ন্যূনতম যোগাযোগও করতে পারছেন না। পাচ্ছেন না কোনো সঠিক দিক নির্দেশনা। মহাসচিবের কাছ থেকেও আসছে না দিকনির্দেশনা। টিভি-পত্রিকা দেখে জানতে হচ্ছে হরতালসহ কর্মসূচির খবরাখবর।
দুই দফা টানা ৬০ ঘণ্টা করে হরতাল পালনের পর আবারও ৮৪ ঘণ্টার হরতাল পালন করছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। গত শুক্রবার বিকেলে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অভিযোগ উঠেছে, এ কর্মসূচির বিষয়েও দলের নিচের সারির তো দূরের কথা, কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতারাও অনেকেই জানতেন না। কর্মসূচি পালনের বিষয়ে তৃণমূল নেতাদের কাছে কোনো নির্দেশনাও যায়নি কেন্দ্র থেকে।
এছাড়া হরতাল ঘোষণার পর শুক্রবার সন্ধ্যায় বিএনপির সিনিয়র ৩ নেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও এর আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিবাদ জানাননি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। হরতালের সময় আরও ১২ ঘণ্টা বাড়ানোর ঘোষণাটিও এসেছে দলের যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের কাছ থেকে। যদিও আগের হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা এসেছিল ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের কাছ থেকে।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে জোটের শরিকদের নিয়ে একের পর এক হরতাল কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। কিন্তু বিচ্ছিন্ন কিছু গাড়িতে আগুন, ভাংচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানো ছাড়া নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা যাচ্ছে না। এ কারণেই আন্দোলনে গতি সঞ্চার হচ্ছে না বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতারা।
এদিকে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে আন্দোলনের ভ্যানগার্ড বলে বিএনপি দাবি করলেও তাদের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। অথচ ‘নিরাপদ’ সভা-সমাবেশ ও দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ক্যামেরার সামনে নিয়মিতই উপস্থিত থাকেন নেতাকর্মীরা। কদাচিৎ আগে থেকে ‘আমন্ত্রিত’ ক্যামেরার সামনে দল বেঁধে ৫-১০ জনকে মিছিল করতে দেখা গেলেও পুলিশের উপস্থিতি টের পেলে মুহূর্তেই মিলিয়ে যান তারা। এসবের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রদলের এক নেতা দিরিপোর্টকে বলেন, শীর্ষ নেতারা নিজেরাও মাঠে নামেন না, আমাদেরও মাঠে নামতে উদ্বুদ্ধ করেন না। যদিও ঢাকায় রাজপথ দখলের সব শক্তিই ছাত্রদল-বিএনপির আছে।
তবে একে আন্দোলনের কৌশল বলেই দাবি করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রথম দুই দফা হরতালের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘হরতালে দলের নেতারা ঢাকায় মাঠে থাকবেন না এটাই আমাদের কৌশল। রাজধানীতে বিভিন্ন বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করে দলের নেতাদের মাঠে নামতে দিচ্ছে না সরকার। তবে আগামীতে আমাদের সব নেতাকর্মী মাঠে নামবেন।’
এদিকে মাঠপর্যায়ের আন্দোলনে থাকা নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, আন্দোলনের সময় মাঠে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুপস্থিতি দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের হতাশ করছে। সারাদেশে সফল হরতাল কর্মসূচি পালন হলেও রাজধানীতে হরতালে মাঠে থাকেন না নেতাকর্মীরা। ঢাকায় যত এমপি প্রার্থী রয়েছেন, তারা যদি ৫০জন করেও লোক নিয়ে মাঠে নামতেন, তাহলেও রাজধানীতে আন্দোলনের চেহারা পাল্টে যেত।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দিরিপোর্টকে বলেন, কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি দায়িত্ব নিয়ে আমরা সর্বাত্মক ও সফলভাবে পালন করছি। কেন্দ্রেরও উচিত আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা। তাহলেই আন্দোলন সফল হবে।’
দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের আত্মগোপন চলমান সরকার বিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে কি না, এমন জিজ্ঞাসার জবাবে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ দিরিপোর্টকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আত্মগোপনে চলে গেছেন, এমনটা নয়। মহাসচিব আড়ালে থাকা আন্দোলনের একটি পন্থা।
রিজভী বলেন, বিশ্বের যে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের কথা আমরা জানি, তা সফলে নেতারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন। আমাদের দেশে বিরোধী দলের আন্দোলন দমাতে সরকার পুলিশি নির্যাতন-নিপীড়ন করে যাচ্ছে। সেসব থেকে রাজনীতিক নেতারা এই পন্থা অবলম্বন করেছে।
তিনি আরও বলেন, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের আড়ালকে ঘিরে দলের কর্মসূচি সফলে ও নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ছে না।
(দিরিপোর্ট/টিএস-এমএইচ/এইচএসএম/নভেম্বর১৩,২০১৩)