দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক:  তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলে অংশ নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদ ছাড়ার কোনো সিদ্ধান্ত তিনি ও আরেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নেননি। এ ধরনের পরিস্থিতি হলে তারাই আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবেন।

বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) রাজধানীর তথ্য ভবনে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত সাংবাদিক এবং অসুস্থ–অসচ্ছল সাংবাদিকদের কল্যাণ অনুদান এবং সাংবাদিকদের সন্তানদের বৃত্তির চেক বিতরণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নাহিদ ইসলাম এ কথা জানান।

এর আগে, আজ একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে ঘোষিত হতে যাওয়া দলে যোগ দিতে সরকার থেকে পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ।

প্রতিবেদনটির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘প্রতিবেদনটি আমার নজরে এসেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেখেছি। কিন্তু পত্রিকায় আসলে কোন উৎস থেকে এটা বলা হয়েছে, এটা আসলে পরিষ্কার করা হয়নি। এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত আসলে এখনো হয়নি। এ রকম যদি হয়, সেটা আমরা নিজেরাই বলব। রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ করার মতো পরিস্থিতি হলে সরকার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলে আমরা সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে বলব। সে রকম কোনো সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত আমার বা আসিফের (উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া) জায়গা থেকে হয়নি আসলে।’’

এরপর সাংবাদিকেরা জানতে চান, রাজনৈতিক দল গঠনের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘‘এখনো আমরা এটা ভাবিনি। আমরা তো সরকারের কার্যক্রমই করছি। এই আলাপটা আসছিল, যখন আসলে রাজনৈতিক দল থেকে সরকারে থেকে রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণের কথা বলা হচ্ছিল। তখন কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলেছিলাম, নতুন রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো দল হোক, আমরা সরকারে থাকা অবস্থায় সেটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হব না। এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোনো পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত আমাদের নেই।’’

প্রকাশিত সংবাদটি ভুল কি না, এমন প্রশ্নে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘‘উৎসটা তারা পরিষ্কার করেনি। সে ক্ষেত্রে আরেকটু দায়িত্বশীলভাবে এটা প্রচার করা উচিত ছিল। এটা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবাদ আসলে। সে ক্ষেত্রে তাদের উৎসটা বলা উচিত ছিল। আমাদের জায়গা থেকে এ রকম হয়নি আসলে। এ ধরনের সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে আরেকটু দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলে সবার জন্য ভালো হয়।’’

আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গ

আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ কেন করা হচ্ছে না, এক সাংবাদিকের প্রশ্নে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘‘এ বিষয়ে সরকার এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি, যেহেতু বিচারকাজ চলমান।’’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা বিচার কার্যক্রমটা আগে দেখতে চাই। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার বিষয়ও আছে। কারণ, এটি কেবল আইনগত সিদ্ধান্ত নয়, একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও। তবে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে আমি বা ছাত্রদের জায়গা থেকে ছাত্ররাও বলেছে, আমরা মনে করি যে আওয়ামী লীগ ১৫ বছর যে ফ্যাসিবাদ করেছে, জুলাইয়ে যে ধরনের গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে; তারপর আওয়ামী লীগের আর রাজনীতি করার আসলে অধিকার নেই।’’

আওয়ামী লীগ নামে রাজনীতি করার সুযোগ আসলে বাংলাদেশে আর থাকা উচিত নয়—এমন মন্তব্য করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘‘সেটার আইনগত ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কী হবে, সেটা হয়তো আমাদের আলোচনা করে বের করতে হবে। পাশাপাশি এটাও বলেছি যে, আমরা কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসাও শুরু করতে চাই না। আমরা রিকনসিলিয়েশন (বিরোধ দূর করা) চাই, আবার জাস্টিসও (ন্যায়বিচার) চাই। সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না, এ রকম সমর্থকগোষ্ঠী ও নেতাকর্মী, তাদের একটা রিকনসিলিয়েশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সমাজকে আমরা বিভাজিত অবস্থায় রাখতে পারি না।’’

জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রস্তুতি আছে

সরকারের জায়গা থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি আছে বলেও সাংবাদিকদের জানান নাহিদ ইসলাম। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এখন রাজনৈতিক দল বিএনপি এখানে দেরি করছে। তারা একটু সময় চাইছে। আমরা তাদের সেই সময়টা দিয়েছি। এখন দেখা যাক তাদের উত্তরটা কী আসে।’’

নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘‘ছাত্রদের জায়গা থেকে এটা প্রথমে এককভাবেই ঘোষণার সিদ্ধান্ত ছিল। যখন রাজনৈতিক দলগুলো এটার অংশীদার হতে চেয়েছে, তখন সরকার একটা উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় ঐক্য রক্ষার স্বার্থে। সেই ঐক্য ও গণঅভ্যুত্থানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের কাজ দ্রুত এগোনো উচিত। সরকারের জায়গা থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে।’’

রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গ

উপদেষ্টা বলেন, ‘‘বিদ্যমান কাঠামো থেকে গেলে যে সরকারই আসুক, ফ্যাসিবাদ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। আমরা তা হতে দেব না। রাষ্ট্র সংস্কার এজন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর জন্য সময় লাগবে। সেই কাঠামো তৈরি হবার পর যে সরকারই আসুক, তারা কাঠামোকে ধরে রাখবে।’’

তিনি বলেন, ‘‘আন্দোলনে আমরা ধাপে ধাপে এগিয়েছি। কোটা সংস্কার, নির্যাতন ও হত্যার বিচার এবং ফ্যাসিবাদের বিচার করতে হবে। এ সকল ঘটনার আসামি শেখ হাসিনার অবশ্যই বিচার করা হবে। দমন-পীড়ন নয় বরং বিচারের মাধ্যমে দেশে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা হবে।’’

নাহিদ বলেন, ‘‘গত পনেরো বছরে কার কী ভূমিকা ছিল, তা ভুলে না গিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করতে হবে। জুলাই আমাদের ঐক্যের শিক্ষা দেয়; শিক্ষা দেয় যে, সমাজে অনেক ভিন্ন মত থাকবে, এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও মতের ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু দেশ, জনগণ ও জাতির সংকটের প্রশ্নে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব।’’

সচেতন ও বস্তুনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য গণমাধ্যমগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘‘আমরা একটি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ সময়ে বাংলাদেশকে নিয়ে বিভিন্নভাবে অনেকে ভ্রান্ত বা ভুল তথ্য দিয়ে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তারা বলছে আমাদের গণমাধ্যম স্বাধীন নয়। সরকারের ওপর থেকে আপনাদের ওপর কোনো ধরনের চাপ নেই। আপনারা সত্যটা প্রচার করুন।’’

তিনি বলেন, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা সকল সমালোচনাকে স্বাগত জানান। আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে চাই। কিন্তু তাই বলে ফ্যাসিবাদের দোসররা যদি সুযোগ নিতে চায়, ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন করতে চায়, তবে আমরা কঠোর হব।’’

তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘‘বিগত সময়ে সকল প্রতিষ্ঠানেই দলীয়করণ ছিল এবং গণমাধ্যমগুলোর অনেকেই তার ব্যতিক্রম ছিল না। তবু অনেকে ঝুঁকি নিয়ে সত্যের ও ন্যায়ের পক্ষে থেকেছেন। যে সময়টা ইন্টারনেট ছিল না, সেই সময় তাদের কারণে প্রকৃত অবস্থাটা জানা গেছে।’’

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও সংবাদ প্রচার করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ভূমিকার জন্য শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ছাত্র ও শ্রমিকদের সাথে তারাও লড়াই করেছেন। তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিতে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’’

তিনি বলেন, ‘‘পাঁচটি শহীদ পরিবারকে আজকে আমরা একসাথে পেয়েছি, তাদের জন্য ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় কিছু করতে পেরেছি, এটা আমাদের জন্য আনন্দ ও গর্বের বিষয়। আমরা আশা করি এই বৃত্তি প্রদানের কাজ অব্যাহত থাকবে।’’

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল্লাহ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা ফারজানা।

জুলাই আগস্টে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে তথ্য সচিব মাহবুবা ফারজানা বলেন, ‘‘আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের কাছে আমাদের অনেক ঋণ রয়েছে। সেই সঙ্গে বিগত সতের বছরে সাংবাদিক ভাইয়েরা যারা শত লোভের প্ররোচনা সত্ত্বেও ন্যায় ও সত্যের সাথে থেকেছেন, তাদের প্রতি আমরা ঋণী।’’

তিনি বলেন, ‘‘আজকের এ অনুদান আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও সাংবাদিকদের অধিকার। তথ্য উপদেষ্টার ঐকান্তিক চেষ্টায় তা সম্ভব হয়েছে। তার চেষ্টায় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ২ কোটি টাকার অনুদান অনুমোদিত হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রবীণ পেনসন ব্যবস্থা চালুর কাজ চলছে এবং নিয়মিত বৃত্তির ব্যবস্থা কার্যক্রম চালু থাকবে।’’

শুভেচ্ছা বক্তৃতা দেন ট্রাস্ট সদস্য-এখন টিভির সাংবাদিক সাজিদ আরাফাত, বিএফইউজে নির্বাহী সদস্য শাহীন হাসনাত, ডিইউজে-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বাকের হোসেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ূব ভূঁইয়া, বিএফইউজে’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার, ডিইউজের সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম, শহীদ সাংবাদিক মো. তাহির জামান প্রিয়র মা শামসি আরা জামানসহ আরো অনেকে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শহীদ সাংবাদিক মো. মেহেদী হাসান, মো. শাকিল হোসেন, আবু তাহের মোহম্মদ তোরাব, সোহেল আখঞ্জি, তাহির জামান প্রিয় ও প্রদীপ কুমার ভৌমিক এর পরিবারের সদস্যরা এবং অনুদান প্রাপ্ত সাংবাদিক পরিবারের সদস্যরা।

অনুষ্ঠান শেষে তথ্য উপদেষ্টা উপস্থিত অনুদানপ্রাপ্ত সকলের হাতে চেক তুলে দেন।

ঢাকা/এনএইচ