দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার জন্য প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার সময় মেজাজ হারালেন উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান।

বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সামনে এসে কথা বলার সময় উত্তেজনা তৈরি হলে ঢাবি উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ তাদের উদ্দেশে বলেন, “তোমরা যদি মনে করো, তুমি আর আমি আলাদা পক্ষ, আমি এখানে দাঁড়ায়ে আছি; আমাকে মার বেটা, মার।”

এরপর তিনি বলেন, “চিৎকার কইরো না।” তখন শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলেন, “সিনেমা কইরেন না, স্যার, সিনেমা কইরেন না।”

উপাচার্যের এমন কথা শুনে মুহূর্তকালের জন্য হট্টগোলে কিছুটাস্তবদ্ধতা তৈরি হয়, যা পরক্ষণেই কেটে যায়। আবার হইহট্টগোল শুরু হয়।

ঢাবি শিক্ষার্থী স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক শাহরিয়ার আলম সাম্যকে মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেএবং ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেন শিক্ষার্থীরা। তার মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে বিক্ষোভ করেন।

রাত ৩টার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিতে থাকেন। সেখানে উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ এসে কথা বলার সময় মেজাজ হারান তিনি।

বিক্ষোভকারীদের সামনের সারিতেছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির, ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস ও সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনকে দেখা যায়।এ ছাড়া ঢাবি শাখা ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভে অংশ নেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও বিক্ষোভে দেখা যায়।

উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভের সময় উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করে স্লোগান করে দিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির তার বক্তব্যে দুজনের পদত্যাগ দাবি করেন।

উপাচার্যের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার সময় বিক্ষোভকারীদের বলতে শোনা যায়, “বাংলা একাডেমির সামনে সাম্যকে হত্যার পর খুনিরা কীভাবে পালিয়ে গেল? আপনার প্রক্টরিয়াল টিম তো দোয়েল চত্বরে আছে। তাহলে তারা কেন খুনিদের ধরতে পারেন না?”

হট্টগোলের মধ্যে অনেক কথাই বোঝা যায়নি। তবে সবাইকে থামিয়ে উপাচার্য নিয়াজ আহমেদের “আমাকে মার বেটা, মার” বক্তব্যটি পরিষ্কার শোনা গেছে।

এ সময় শিক্ষার্থীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তৎক্ষণাৎ উপাচার্যকে সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি দেখার কথা বলেন। এ সময় একজন বিক্ষোভকারীকে বলতে শোনা যায়, “স্যার, আপনি তো আমাদেরই লোক।”

তখন উপাচার্য নিয়াজ বলেন, “তোমাদের পদক্ষেপগুলো বলো।” পাশ থেকে একজন শিক্ষার্থী বলে ওঠেন, “আপনি পদত্যাগ করেন।”

উপাচার্যকে “আপনি আমাদেরই লোক বলা” শিক্ষার্থী তখন ক্ষোভ প্রকাশ করেন, “আপনারা যদি আমাদেরই লোক হন; তাহলে সাম্যর ঘটনার সময় আমি প্রক্টরকে ফোন দিছি; তিনি ফোন ধরেন নাই- কেন?”

উদ্যানের নিরাপত্তা নিয়ে উচ্চবাচ্যের মধ্যে একজন স্লোগান ‍দিয়ে ওঠেন, “ব্যর্থ ভিসির বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন।” এরপর শিক্ষার্থীদের কথামতো তাদের সঙ্গে উদ্যানের দিকে যান উপাচার্য। তখনো হইহট্টগোল চলছিলই।

উপাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে উদ্যানের দিকে যেতে যেতে বিক্ষোভাকারীরা স্লোগান দিতে থাকেন, ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই,’ ‘ব্যর্থ ভিসির গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে’, ‘সাম্য ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’।

এ সময় কিছু শিক্ষার্থীউপাচার্যকে দেখে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন এবং তার পদত্যাগ দাবি করেন।

এদিকে সাম্যর হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ চেয়ে বুধবার (১৪ মে) বেলা ১১টায় সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছে ছাত্রদল।

পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে বুধবার বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শাহরিয়ার আলম সাম্যের জানাজা হতে পারে বলে জানিয়েছেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির।

তিনি বলেন, “বিভিন্ন ক্যাম্পাসে হত্যার রাজনীতি শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে একজন মানসিক ভারসাম্যহীনকে হত্যা করা হয়েছে। প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে।”

নাছিরের অভিযোগ, “আজ ছাত্রদলের পরীক্ষিত নেতা সাম্যকে যেভাবে হত্যা করেছে, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন শতভাগ নিষ্ক্রিয় ছিল। গত ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির বদলে একটি ছাত্র সংগঠনকে বিভিন্ন হলে দখলদারিত্ব করতে সহায়তা করেছে প্রশাসন।”

তিনি আরো বলেন, “৫ আগস্টের পর হলগুলোতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিচার আমরা দেখিনি।হলেপুরোপুরি তদন্ত করে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে দেখিনি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় এখনো বিচার শুরু হয়নি।”

এর আগে রাত ২টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) থেকে তাৎক্ষণিক মিছিল বের করে ছাত্রদল। তাদের সঙ্গে যোগ দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

মিছিলে ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, নাসির উদ্দিন নাসির, ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস, সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় তারা ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব দে’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘ক্যাম্পাসে লাশ পড়ে, ভিসি-প্রক্টর কী করে’স্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা।

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে দেখা যায় ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের।

বিক্ষোভ শেষে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কীভাবে একজন শিক্ষার্থীকে প্রকাশ্যে মধ্যরাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয়? উপাচার্য কীভাবে মুচকি হাসি রেখে সপদে বহাল থাকেন?”

অন্তর্বর্তী সরকারকে হুঁশিয়ার করে গণেশ চন্দ্র বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার দেশের কোথাও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থতির উন্নত করতে পারেনি। এ সরকারের কাছে অতিদ্রুত ভিসি ও প্রক্টরকে সরানোর দাবি জানাচ্ছি। না হলে শুধু ভিসি ও প্রক্টরের বিরুদ্ধে নয়, আমরা ইন্টেরিম সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য হব।”

ঢাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-২০১৯ সেশনের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রদলের স্যার এ এফ রহমান হল শাখার সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক শাহরিয়ার আলম সাম্যকে সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেছে। তিনি এফ রহমান হলের ২২২ নম্বর কক্ষে থাকতেন। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায় সাম্যকে।

মঙ্গলবার (১৩ মে) রাত ১২টার দিকে রক্তাক্ত অবস্থায় সাম্যকে তার সহপাঠীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সাম্যের সহপাঠী, সিনিয়র, জুনিয়র, শিক্ষকসহ ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ছুটে আসেন মেডিকেল প্রাঙ্গণে।

সাম্যর মৃত্যুর খবরে ফুঁসে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাতের ক্যাম্পাস। তারা রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ শুরু করেন।

সাম্যর ওপর হামলার সময়সঙ্গে ছিলেন তার সহপাঠী বায়েজিদ। তার কাছে হামলার মুহূর্তের বর্ণনা পাওয়া গেছে।

ঢাকা মেডিকেলে কথা হলে রাইজিংবিডি ডটকমকে বায়েজিদ বলেন, “রাত ১২টার দিকে আমরা তিন বন্ধু মিলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কালী মন্দির-সংলগ্ন গেটের পাশে ক্যান্টিনে আড্ডা শেষে বের হয়ে আসছিলাম। এ সময় ৮-১০ জনের একটি দল আমাদের ওপর হামলা করে।”

“তাদের ছুরির আঘাতে সাম্যর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। মেডিকেলে আনা হলে সে মারা যায়।”

বায়েজিদ আরোবলেন, “তাদের মধ্যে একজনকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু পরে শুনি তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।”