দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক: যাদের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে, ইতিহাস বদলে দেওয়া সেই শহীদদের যথাযথ সম্মান ও মর্যদা দেওয়া হচ্ছে না। এক বছরে শহীদদের পূর্ণাঙ্গ নির্ভুল তালিকা হয়নি। তাদের সংখ্যা নিয়ে সরকার এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যে গরমিল রয়েছে। এছাড়াও শুরুতে নির্ভুল তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও বর্তমানে তা গতিহীন হয়ে পড়েছে। 

তাদের কবরগুলোও সংরক্ষণে তেমন উদ্যোগ নেই। এতে অনেক শহীদের নাম হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া আন্দোলনের শেষ সময়ে রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে গণকবরে ১১৪ জনের লাশ দাফন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই লাশ উত্তোলন করে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। এছাড়াও অভ্যুত্থানে শহীদ ছয়জনের লাশ এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে। এগুলো শনাক্তে কার্যকর উদ্যোগ নেই। শহীদদের ব্যাপারে উদ্যোগ শুধু কথাতে ও কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।

এ ঘটনার সঙ্গে ১৯৭১ সালের একটি মিল দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ওই সময়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। ফলে এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোও ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা করছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পরও নতুন পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোও একই কাজ করছে। অথচ শহীদদের তালিকা তৈরির ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।

জানতে চাইলে জুলাই আন্দোলনে শহীদ মো. নাঈমের বাবা কামরুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। কিন্তু সেভাবে সম্মান মর্যাদা পাইনি। কাগজ কলমে অনেক উদ্যোগের কথা বলা হয়। কিন্তু এর সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সে সহযোগিতা পেতে কী পরিমাণ ভোগান্তি তা বলে বুঝানো যাবে না। তিনি বলেন, ছেলে কবরটিও ভালোভাবে বাঁধাই করে দেওয়া হয়নি। আমাদের যখন কোনো সমাবেশে ডাকা হয়, তখন অনেক কথা বলে। অনুষ্ঠান শেষ হলে রূপ পাল্টে যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতের সমর্থনে দেশের ওপর টানা ১৬ বছর চেপে বসে ছিল ভয়ংকর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। তার ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এর বিরুদ্ধে জেগে ওঠে ছাত্র-জনতা। আন্দোলনটা কোটা দিয়ে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত হাসিনার পতনে গিয়ে থামে। তবে আন্দোলন দমাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালায় হাসিনা। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়, এক হাজার ৪০০ নিরস্ত্র মানুষ। আহত হয়েছে কমপক্ষে ১৫ হাজার। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এই নৃশংস পথ বেছে নেয় হাসিনা। এরপর প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে শুরুতে শহীদদের ব্যাপারে অনেক কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান অন্যান্য ইস্যুর আড়ালে শহীদরা হারিয়ে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজয় ১৯৭১ সালে। ওই সময়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। স্বাধীনতার পর শহীদদের তালিকা করার জোরালো দাবি উঠেছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়নি। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি আছে।

শহীদদের তালিকা : চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে বলা হয়, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনায় এক হাজার ৪০০ জনকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ১১৮ জনই শিশু। শতকরা হিসাবে যা ১২-১৩ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুসারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ৮৪৪ জনকে শহীদ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সময়ে বলা হয়েছিল, তালিকা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। তবে এ পর্যন্ত যাদের শহীদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের পরিবারকে এককালীন ৩০ লাখ টাকা অর্থসহায়তা, মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা এবং এক হাজার ৩৫৫ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

তথ্যে গরমিল : সরকারের গেজেট অনুসারে এ পর্যন্ত শনাক্ত করা শহীদের সংখ্যা ৮৪৪। কিন্তু জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে জুলাই আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা ৮২০। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট সংখ্যায় মিল নেই। এই ফাউন্ডেশনে তথ্যে আহতের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ১১ হাজার ৮৫০ জন। জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং বলছে শহীদের সংখ্যা ১৪শ।

রায়েরবাজার গণকবরে ১১৪ জনের লাশ : জুলাই আন্দোলনে শহীদ ১১৪ জনের লাশ রায়েরবাজার কবরস্থানের গণকবর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশের পরিচয় অজ্ঞাত। এক বছরেও এসব লাশ উত্তোলন করে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী শনিবার এসব লাশ উত্তোলন করে শনাক্তের ঘোষণা দিয়েছেন। ওই সময়ে বলা হয়েছিল, তালিকা যাচাই করা হচ্ছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ৬ জনের লাশ : জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ছয় বেওয়ারিশ লাশের সন্ধান মিলেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ডিএমসি থেকে এ তথ্য জানানো হয়। মর্গে অজ্ঞাতনামা লাশের মধ্যে পাঁচজনই পুরুষ। একজন নারী। লাশগুলোর ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এতে পাঁচজনের মৃত্যুর কারণ হিসাবে লেখা হয়েছে ‘আঘাতজনিত’। একজনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়েছে ওপর থেকে নিচে পড়ে মৃত্যু। এরপর গত ৭ মাসেও ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করে লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।

রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগ : সংশ্লিষ্টরা বলছেন ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে শহীদদের নিয়ে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর অধিকাংশ ভোটের রাজনীতিতে মিডিয়া কাভারেজের জন্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন মিডিয়া চলে গেলে শহীদ বা তার পরিবারের খবর কেউ রাখে না। যে কারণে জুলাই শহীদের পরিবারকে অনাহারে দিন কাটাতে হয়। শহীদের স্ত্রীকে অন্যের বাসায় কাজ করে সন্তানদের জন্য খাবার জোগাড় করতে হয়। শহীদ পরিবারের অনেকেই অভিযেগ করেন, তাদের জন্য অনেক কিছু করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। সরকারি সহায়তা তুলতে গেলে যে ভোগান্তি পোহাতে হয় তা বলে বুঝানো যাবে না বলে তারা মন্তব্য করেন।