বিশেষ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম : তিন পাবর্ত্য জেলায় শনিবার থেকে শুরু হয়েছে বৈসাবি উৎসব। নতুন সাজে সেজেছে পাহাড়ি জনপদ, বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।

পুরনো বছরকে বিদায় জানানো ও নতুন বছরকে বরণ করার লক্ষ্যে উৎসবের কাতারে পাহাড়ের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতারা। ধর্মীয় ও সামাজিক এ উৎসবকে কেন্দ্র করে উৎসবের জোয়ারে ভাসছেন সকল মানুষ।

বাংলা বছরের শেষ দুদিন এবং নতুন বছরের পাঁচ দিন পাহাড়ে চলে উৎসবের ঘনঘটা। প্রতিটি পাড়া হয়ে উঠে উৎসবমুখর। নতুন পোশাক কেনাকাটার পাশাপাশি আগেভাগেই তারা ঘরদোর সাজানোর কাজ করেন।

বছরের শেষ দুদিন পাহাড়িরা ব্যস্ত থাকেন ধর্মীয় নানা আচার প্রথায়। বছরের প্রথমদিন মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রোসহ আরও কয়েকটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বৌদ্ধমূর্তি নিয়ে বের করেন শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় ধর্মীয় গুরু থাকেন সামনে, এতে অংশ নেন আদিবাসী নারী-পুরুষ। এরপর নদীর তীরে গিয়ে চন্দনমিশ্রিত পানিতে মূর্তিকে গোসল করিয়ে বছরের প্রথমদিন থেকে নতুনভাবে চলার ধর্মীয় দীক্ষা গ্রহণ করেন সকলে।

শোভাযাত্রার পর পানি দিয়ে জানানো হয় মঙ্গল বার্তা। যাকে বলে ‘পানি খেলা’। নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে পানি ছিটিয়ে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য প্রকাশের পাশাপাশি তরুণ-তরুণীরা ভালোবাসার প্রকাশ ঘটান।

পরের দিন থেকে চার দিনব্যাপী চলে পাহাড়ের সর্বত্র পানি খেলাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে তৈলাক্ত বাঁশে আরোহণ, বলিখেলা, দাঁড়িয়াবান্ধা, চোখ বেঁধে মাটির হাঁড়ি ভাঙা, ভলিবল, লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অন্যতম।

উৎসবের শেষ দুদিন চলে পাড়ায় পাড়ায় পিঠা তৈরি। ছেলেমেয়েরা আলোকসজ্জা করে, গান-বাজনা বাজিয়ে রাত জেগে পিঠা তৈরি করেন। আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিতরণ করা হয় এ পিঠা। তঞ্চঙ্গ্যাদের ঘিলা খেলা, চাকমাদের নদীর জলে ফুল ভাসিয়ে দেওয়া অনুষ্ঠানও বেশ আকর্ষণীয়।

নববর্ষকে ঘিরে রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে দিনব্যাপী বর্ষবরণের বিভিন্ন আয়োজন।

অন্যদিকে বান্দরবানেও শুরু হয়েছে নানা কর্মসূচি। বান্দরবানে আজ উপজাতি সম্প্রদায় কিছু কর্মসূচি পালন করলেও আগামীকাল (১৩ এপ্রিল) থেকে মূল উৎসব শুরু হবে। ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ সরকারিভাবে আয়োজন করা হবে পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা, যেমন খুশি তেমন সাজ, বলি খেলা, ঘুড়ি উড়ানো উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এ ছাড়া সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজন করা হয়েছে পান্তা-ইলিশ ভোজন উৎসব।

চাকমাদের বিজু : বৈসাবি উৎসবের দ্বিতীয় দিনে চাকমা ও ত্রিপুরাদের ঘরে ঘরে রান্না হয় ঐতিহ্যবাহী পাচন। পাচনসহ নানা উপাদেয় খাবার দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়।

চৈত্রের শেষ দিনকে মূল বিজু হিসেবে পালন করা হয়। এটাই হচ্ছে মূল উৎসব। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের পিঠা, তিলের নাড়ু, বিন্নি ধানের খৈ ও মিষ্টি তৈরি করা হয়।

চাকমা তরুণীরা তাঁতের বোনা রঙিন খাদি কাপড় বুকে জড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ান। অপরাহ্ণে তরুণ-তরুণীরা একসঙ্গে স্থানীয় ঘিলা, পোত্তা খেলায় মেতে উঠে। একসঙ্গে ঘিলা, পোত্তি (বউচি) প্র্রভূতি খেলায় মেতে উঠে।

তঞ্চঙ্গ্যাদের বৈসুমা বা বিসুমা : চৈত্র সংক্রান্তির দিনকেই তারা বৈসুমা বা বিসুমা হিসেবে পালন করে থাকেন। এ সময় ঘরদোর পবিত্র করা হয়। বাড়িতে বাড়িতে পিঠা তৈরি করা হয়। রাগ, অভিমান, হিংসা ক্ষোভ বিসর্জন দিয়ে পরস্পরের প্রতি আন্তরিক সৌহার্দ্য প্রদর্শন করে।

মারমাদের সাংগ্রাই : সাংগ্রাইকে ঘিরে মারমারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পানি খেলার আয়োজন করে থাকে। মারমাদের ঐতিহ্যবাহী উৎসবে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।

পাহাড়ের তরুণ-তরুণীরা প্যান্ডেল তৈরি করে তার নিচে নৌকা ভর্তি রঙিন পানি নিয়ে ঐতিহ্যবাহী খেলায় মেতে উঠে। নৌকা থেকে পানি নিয়ে একে অপরের গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে এবং পুরনো বছরকে বিদায় জানায়। এ ছাড়া বৌদ্ধমন্দিরে গিয়ে পুরনো বছরের সকল ব্যর্থতাকে দূর করে নতুন বছর নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে জীবন সংগ্রামে সাফল্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানায়।

(দ্য রিপোর্ট/কেএইচএস/একে/সা/এপ্রিল ১২, ২০১৪)