জোসনা জামান, দিরিপোর্ট : দাতাদের ঋণের অর্থে রেলের কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে মেয়াদ শেষ হলেও প্রকল্পগুলোর সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এ উদাসীনতায় অন্যান্য প্রকল্পে দাতাদের সহায়তার ব্যাপারে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

এ পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানে কয়েকটি মেগা প্রকল্পকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে রেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য ও পরিকল্পনা সচিব ভূঁইয়া শফিকুল ইসলাম দিরিপোর্টকে জানান, প্রকল্পগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। যেহেতু এগুলোতে বৈদেশিক সহায়তা রয়েছে, তাই আইএমইডি’র (বাস্তবায়ন, পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) সুপারিশ মন্ত্রণালয়গুলোর গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।

এডিবি’র (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের যুগ্ম সচিব আবু সাইদ ফকির দিরিপোর্টকে বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবাস্তনে দেরি হলে পরবর্তী প্রকল্পে এর খারাপ প্রভাব পড়বে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে দাতারা এ রকম ধীর গতির প্রকল্পের অর্থ কেটে অন্য মন্ত্রণালয়ে দিয়ে দেয়। এতে যে মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বাতিল করা হয়, সে মন্ত্রণালয়ের রেকর্ড খারাপ হয়ে যায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘বন্দর ও বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। যাত্রী সাধারণ ও মালামাল পরিবহনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে রেললাইনটিকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা অত্যাবশ্যক।’

দেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্রগ্রাম রেললাইনে দুই হাজার ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সিগন্যালিং ও টঙ্গী-ভৈরববাজার পর্যন্ত ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় ২০০৬ সালে। চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত একল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৩৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। অথচ আগামী বছরেই এটি বাস্তবায়নের মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে সরকারের পর্যবেক্ষণ সংস্থা বাস্তবায়ন, পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এতদিনে যে পরিমাণ কাজ এগিয়েছে তা প্রত্যাশার তুলনায় খুবই কম।

আইএমডির এ মূল্যায়নের প্রেক্ষিতে কেন প্রকল্পটির কাজ এগুচ্ছে না- তা খতিয়ে দেখতে নিবিড় পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

একইসঙ্গে, যোগাযোগের সাব সেক্টর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ রেলওয়ে সংস্কার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ২০০৬ সালে। সাংগঠনিক কাঠামো ও নীতি সংস্কারের কর্মসুচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে রেলওয়ের দক্ষতার উন্নয়ন করাই ছিল এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। ২৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত এ প্রকল্পের মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। অথচ মে পর্যন্ত এ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ২৮ শতাংশ। প্রকল্পটি আবারও মেয়াদ বাড়ানোর পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

রেল মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছে, এ প্রকল্পের সফলতার ওপর রেলওয়ের আরও গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়নে সফলতা দেখাতে না পারলে টঙ্গী-ভৈরববাজার ও লাকসাম-চিনকি ডাবল লাইনে এডিবি অর্থায়ন করবে না। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে ত্রুটিসহ ক্রয় সংক্রান্ত নানাবিধ জটিলতায় অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়নের মেয়াদ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

এ প্রসঙ্গে সরকারি প্রকল্পগুলোর তদারকি করা আইএমইডি বলছে, এডিবির আর্থিক সহায়তায় এ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল। নানা জটিলতার কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি আশানুরুপ নয়। বর্তমানে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রস্তাবিত সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন।

আইএমইডির পক্ষ থেকে আরডিপিপি সংশোধন ছাড়াই প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এ অবস্থায় প্রকল্পটি নিবিড় পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এছাড়া প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের পাবর্তীপুর-কাঞ্চন-পঞ্চগড় ও কাঞ্চন বিরল মিটারগেজ সেকশনকে ডুয়েল গেজে এবং বিরল ও বিরল বর্ডার সেকশনকে ব্রডগেজে রুপান্তরকরণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০০৯ সালে গৃহীত এ প্রকল্পটি বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ট্রানজিট চুক্তির আলোকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বাস্তবায়নে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৬৮ শতাংশ। ৯৮১ কোটি ৭১ লাখ টাকা মোট প্রক্কলিত ব্যয়ের মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত হিসাব অনুসারে ব্যয় হয়েছে ৬৭২ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ অবস্থায় প্রকল্পটির বাস্তবায়নের কাজ কেন শেষ হচ্ছে না- তার কারণ খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে সরকারের তদারককারী সংস্থা আইএমইডি।

রেল মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছে, রেলের উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হলেও বাস্তবায়নে অদক্ষতা ও কিছু ক্ষেত্রে অক্ষমতার কারণে গতি আনা যাচ্ছে না। এছাড়া নতুন অর্থ বছরের শুরুতে একটু উদাসীনতার সঙ্গে সরকারের মেয়াদ শেষের দিকে হওয়ায় কাজে গতি হারিয়েছে কর্তব্যরতরা।

বিষয়টি স্বীকার করে রেল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বছরের প্রথম দিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কিছুটা কম হতে পারে। তবে সামনের দিনগুলোতে দ্বিগুণ গতিতে কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি আগামী মাস থেকেই এর কার্যকারিতা দেখা যাবে।

সূত্র জানায়, গত কয়েকবছর ধরে বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকার রেল মন্ত্রণালয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্বের তালিকায় রেখেছে। চলতি অর্থ বছরে রেল মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৫১টি উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয় তিন হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ বছরের প্রথম মাসে এ বরাদ্দ থেকে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ। দ্বিতীয় মাস আগস্টে এ বাস্তবায়নের হার ১০ শতাংশও হয়নি। এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তিন হাজার ২১ কোটি টাকা। এ অর্থে ৫৫টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও পুরোপুরি অর্থ ব্যয় করতে পারেনি মন্ত্রণালয়।

(দিরিপোর্ট/জেজেড/এসকে/নভেম্বর ১৮, ২০১৩)