যৌতুকের টাকা জোগার হলোনা সাত তরুণীর
গাইবান্ধা: নিজের বিয়ের যৌতুকের টাকা যোগার করা হলো না তরুণী রেবা বেগমের। বাবা গরীব, মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেয়ার ক্ষমতা নেই। তাই চাকরি করে যৌতুকের টাকা যোগার করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরতে হলো রেবা, হাসিনা, দুলালী, সাজেদা, শিউলীসহ গাইবান্ধার সাত দরিদ্র তরুণীকে ।
সাভারের বহুতল ভবন ধসের ঘটনায় জেলা সদর, সাদুল্লাপুর, সুন্দরগঞ্জসহ কয়েকটি উপজেলায় বৃহস্পতিবার ৬ তরুণীসহ ৮ জনের লাশ তার স্বজনরা এলাকায় নিয়ে এসেছেন। গাইবান্ধার সেসব গ্রাম জুড়ে এখন স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস।
জামুডাঙ্গা গ্রামের শাজাহান মিয়ার মেয়ে রেবা বেগম (১৮)। বাবার অভাবের সংসার। টাকা পয়সা ছাড়া বিয়েও হয়না। তাই নিজের যৌতুকের অর্থ যোগাতেই চলে যান সাভারে গার্মেন্টসে। বয়সে তরুণী। তারপরও বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে সাভারের যান। কাজ করে কয়েক মাস মায়ের হাতে টাকাও দেন। মা এ টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন মেয়ের বিয়ের জন্য।
মাঝে মাঝে ফোনে মাকে বলতো মা আমার জন্য দোয়া করো, আমি যেনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি।
দুর্ঘটনার আগের রাতেও মায়ের সাথে অনেকক্ষণ কথা হয় রেবার। মায়ের সঙ্গে শেষ কথা ছিলো- বিয়ের জন্য চিন্তা করো না। কারণ এ দুনিয়ায় টাকা আর যৌতুক ছাড়া কেউ বিয়ে করেনা। তাই আমি যৌতুকের টাকা যোগার করেই বাড়িতে আসবো। বিয়ের জন্য তোমরা পাত্র দেখবে। বিয়ের শাড়ি কিনে আনবো।
এরপর সকালে আর কোনো কথা হয়নি কারো সাথে। সকালে উঠে কাজে গিয়ে ভবনের কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
কথা বলা শেষ করেই মা রোমেনা বেগম মেয়ের লাশের পাশে মাটিতে গড়াগরি করে বিলাপ শুরু করেন।
বুক চাপড়ে বলতে থাকেন, আমার মেয়েকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও-আমি না খেয়ে থাকলেও আমার মেয়ের মুখ দেখে পাথর বেঁধে জড়িয়ে থাকতে চাই।
সাদুল্লাপুরের পূর্ব দামোদরপুর গ্রামের দিনমজুর ঘরে জন্ম হয় হাসিনা খাতুনের(১৫)। আর কত দিন অনাহারে থাকা যায়। ভাঙ্গা ঘর আর নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে দরকার টাকার। দিন মজুর বাবার ঘরে উপোশ থাকতে থাকতে পেটে পাথর হয়ে গেছে। পরনে কাপড় নেই । ছোট ভাই বোন আর বাবা মায়ের ছেঁড়া কাপড় দেখতে ইচ্ছে হয়না। ঈদ উৎসবে মাংস পোলা ও নতুন কাপড় তো দূরের কথা সেমাই চিনির যোগার করার মতো ক্ষমতাও হয়না ।
এ অবস্থায় কিশোরী হাসিনা বাবা মায়ের সুখের আশায় ঘর ছেড়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে যান। কাজও জুটে যায় । বছর খানেক সাভারে কাজ করে মায়ের জন্য শাড়ি, বাবার লুঙ্গি, পাঞ্জাবী আর প্রতিমাসে সাধ্যমতো টাকা পাঠাতো মানুষের হাতে।
বৃহস্পতিবার তার লাশ বাড়িতে মায়ের সামনে এসে পৌঁছে। তার মুত্যুর খবর শুনেই বাড়ির সবাই অজ্ঞান। সারারাত কেঁদে কেঁদে কারো চোখে পানি নেই। শুধু হাহাকার।
এভাবে গাইবান্ধার গ্রামে গ্রামে চলছে শোকের মাতম, আহাজারি।
সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের টেংগরজানি গ্রামের তরুণী মাজেদা বেগম, দুলারী বেগম, শিউলী বেগম, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সুলেখা বেগমসহ এ পর্যন্ত ৮ জনের মৃতদেহ এসে পৌঁছেছে।
তবে এলাকাবাসী ও ইউপি চেয়ারম্যানরা জানান, সাভার ট্রাজেডির শিকারে এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে লাশ এসেছে ৮ জনের । এছাড়া এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ১০ জন।
দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান মুন্সি জানান, তার ইউনিয়নের পূর্ব দামোদরপুর, পশ্চিম দামোদরপুর, মধ্য দামোদরপুর, জামুডাঙ্গা, কান্তানগর ও মরুয়াদহ গ্রামের ৬০/৭০ জন নারী-পুরুষ সাভারের ধসেপড়া ভবনের গার্মেন্টসে কাজ করতো।
সাইদুর মুন্সী আরও জানান, পাওয়ার লাশগুলোর দাফন প্রস্তুতি চলছে।